ছেলেবেলাঃ সেকাল একালঃ পর্ব-২ঃ শীতকাল ও বিনোদন

Dec 20, 2021 | ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-রাজনীতি, গল্প প্রবন্ধ উপন্যাস | 0 comments

ছেলেবেলাঃ সেকাল একালঃ পর্ব-২ঃ
শীতকাল ও বিনোদন

——
আমরা যারা বিংশ শতাব্দির নব্বই দশকে শৈশব কৈশোর পার করার সুযোগ পেয়েছে, তারা বিজ্ঞানের বেগ এতোটা পাই নি সত্য, তবে আমাদের বিনোদন ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত এবং প্রাণোচ্ছ্বাসে ভরা।
একথা বরাবরই সত্য যে, আমাদের সময়ে ছিলোনা আজকের মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ উৎকর্ষ: ইন্টারনেট বিপ্লবতখন সায়েন্স ফিকশনের মতো, তবে আমাদের ছিলো বাঁধহীন দিনের মুক্ত হাওয়ার মতো শৈশব-কৈশোর।

সেসব শীতকাল আর বার্ষিক পরীক্ষার সমাপ্তি যেন বোঝাপড়া করেই আসতো। পরীক্ষার শেষ দিন যেন মুক্তির সুর নিয়ে আসতো। তবে প্রাইমারিতে পরীক্ষা শেষের কিছুদিন পর মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল, ফল ইত্যাদি বানিয়ে, যথাযথ রং করে জমা দিতে হতো বলে মনে পড়ে। আজকালকার এসাইনমেন্টের সাথে তুলনা দেয়া যেতে পারে। এরপর যেদিন ফলাফল দিবে আর যেদিন নতুন বই দিবে – এ দুই দিন যেতে হতো স্কুলে।

পরীক্ষার শেষ। ডিসেম্বরের শুরু বা মাঝামাঝি। তখন নবান্ন পূর্ন যৌবনে। মাঠ-ঘাট-আর-আমাদের বাড়িঘর যেন ‘আমার সোনার ধানে গিয়াছে ভরি’.. পাকা ধানের বিনিময়ে মোয়া।মুড়ি কিনে নিতাম। একসের ধান দিয়ে ৪/৫ টা মোয়া কেনা যেতো।
নতুন ফসল কৃষকের ঘরে উঠা মানেই ফসলের মাঠ শুন্য। বিশাল খেলার মাঠ যেন। এ মাঠের কোন অংশের সমতল ভাগে ফুটবলের মাঠ, কোন অংশে গাড়িয়াবান্ধা (ফঅর খেলা)’র জন্য নির্ধারিত ধাকতো। সবচেয়ে সমতল মাঠকে খেলার উপযোগী করা হতো ক্রিকেটের জন্য। মাঝ অংশে ২২ গজ (+-) পরিমাণ কোদাল দিয়ে সমান করে ক্রিজ বানানো হতো। বাদাম গাছের ডাল নিয়ে তখনো ছেঁটে ক্রিকেট স্ট্যাম্প বানানো হতো। ঘরে থাকা কাঠ দিয়ে ক্রিকেট ব্যাট ছিলো, যতদিন ৬x২ বা ১২ টি স্ট্যাম্প সুলভে ফকিরহাটের মিনু স্যারের দোকান ‘সামগ্রী বিতান’ এ সহজলভৌ হয়নি। আজকের মতো মোবাইলে গেইমস খেলার সুযোগ আমাদের গ্রামীণ শৈশবে কল্পনাতীত ছিলো।
একালের ছেলেবেলায় অফুরন্ত প্রাচুর্য দেখা যায়, দেখা যায় প্রচুর পড়ার চাপ, বকুনির ছাপ, ব্যস্ততার উত্তাপ, প্রযুক্তির প্রভাব, বিজ্ঞানের উতকর্ষতা ইত্যাদি। তবে প্রাণের উচ্ছ্বাস আছে কতটুকু?

সন্ধ্যা গড়িয়ে এলে মাঝে মধ্যে আগুনের কুন্ডলী করা হতো। বয়ষ্করা সে আগুনের উত্তাপে শীত দূর করতেন। শীতের কাপড়ের মধ্যে শাল, সুয়েটার, মাফলার ইত্যাদি জনপ্রিয় ছিলো।
ডিসেম্বর জানুয়ারী ছিলো গ্রামের মেলা পার্বনের মৌসুম। রমজান আলী হাটের পূর্ব বড়ুয়া পাড়ায় দস্সরি বঅর মেলা, রাউজান ফকিরহাট সংলগ্ন কাসখালি কুলে সর্য খোলার মেলা ইত্যাদি ছিলো বেশ জনপ্রিয়। জানুয়ারী মাসের শেষের দিকে হাজি পাড়াস্থ হযরত এজাবতউল্লাহ (রঃ) এর ওরশ হতো বড় আকারে। ওরসে মাটির তৈরি সোয়ালি (বাসন) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আর সে ওরসকে ঘের ৩/৪ দিন ব্যাপী চলতো মেলা। এ মেলার জন্য ছোটবেলায় টাকা জমানো চলতো সারা বছর ব্যাপী। কারো জমা সঞ্চয় হয় ১০/১৫ টাকা, কারো ২০/২৫ টাকা ইত্যাদি, যা মুদ্রাস্ফীতির যুগে কল্পনা তরা সুদূর।
মেলায় অন্যান্য আইটেমের মধ্যে থাকতো নাগরদোলা, থাকতো লটারি, চাকতি, মার্বেল দিয়ে বক্সে লটারি, গুলি দিয়ে বেলুন ফুটানো, বাঁশি, বেলুন, প্লাস্টিকের বন্ধুক/পিস্তলের দোকান, খেলনার দোকান, শরিষার তিলি, কাঁকড়ার ট্যাং নামের সরু শুষ্ক মিষ্টান্ন, নারিকেল পিঠা ইত্যাদি নানা খাবারও। সবাই যে যারর পছন্দমতো জিনিস কিনে ফিরতো আনন্দচিত্তে।
কয়েক বাড়ি মিলে একটা টেলিভিশন ছিলো। ধীরে ধীরে এক বাড়িতে একটা টিভি দেখা যাওয়া শুরু করলো। সাদাকালো টিভির যুগের পর কিছু কিছু রঙিন টিভিও আসতে লাগলো। তাই রবিবারে আজ রবিবার, মঙ্গলবারে অয়োময় বা সংশপ্তক, বুধবারে ম্যাগগাইভার, শুক্রবার বিকালে তিনমাসে একটা ছায়াছবি, রাত ৮/৩০টায় আলিফ লায়লা, তিন মাসে একবার “ইত্যাদি” প্রভৃতি দেখার জন্য যথাসময়ে এ বাড়ি, ও বাড়ি যেতাম। আলিফ লায়লা চলাকালিন বিদ্যুৎ চলে গেলে রমজান আলী হাটের মোনাফ কোম্পানির দোকানে সবাই ছুটতো ব্যাটারিচালিত টেলিভিশনে দেখতে।

স্বচ্ছল ঘরের বিয়ে বাড়ির মেহেদি অনুষ্টানে থাকতো বিশেষ আকর্ষণ ‘ভিসিআর’ বা ভিসিভি। তিন ঘন্টায় একটা সিনেমা হিসেবে তিন সিনেমায় রাত পার হয়ে যেতো। যেকোন একটি হিন্দি সিনেমা (তৎকালীন ভাষায় ‘বই’!) দেখানো হতো। পরবর্তীতে প্যাকেজ অনুষ্টান আসতে থাকতো। মাঝে মাঝে বিলে সামিয়ানা টাঙিয়ে এবং নীচে শীত এড়াতে খড় বিছিয়ে থাকতো কাউয়ালী গান। শুইল্ল্যা চাচার হারমোনিয়াম বাজতো প্রায়শই। গভীর রাত পর্যন্ত সেসব অনুষ্টান শেষে দুরু দুরু মন নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। আজকের দিনের অত্যাধুনিক বিনোদন না থাকলেও
তখনকার বিনোদনে ছিলো ব্যাপক আনন্দ ও রোমাঞ্চ।
বিলের মাঝে প্যান্ডেল টাঙিয়ে, নীচে খড় বিছিয়ে, অতপর রাতব্যাপী মাইকে গান ছেড়ে দিয়ে পিকনিক বা চড়ুইবাতি ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয়। বাড়ির সবাই মিলেও ফোয়াতিভাত বা চড়ুইবাতির আয়োজন করা হতো। বেশিরভাগ কাজ নিজেদের করে আয়োজন করতে হতো। সে এক দারুন প্রাণস্পন্দন! সে এক অশেষ প্রাণসঞ্জিবনী।
আজকের বিনোদনের ধরণ বেশ নানা প্রকারের, বেশ দামী, আধুনিকও। বারবিকিই বা ডিজে পার্টির কথা ইত্যাদি শুনা যায় গ্রামেও। তবে বেশিরভাগই রেডি মেইড। বেশ পরিপাটিও।

‘এককালে ক্ষুধার অন্ন জুটিত না’ পুঁথির প্রতাপ নামক প্রবন্ধে সম্ভবত মোহিতলাল মজুমদার যে আক্ষেপ করেছেন, বিনোদনের ক্ষেত্রেও বলা যায় সে বচন। অর্থাৎ, এখন অক্ষুধা ও দুষ্টুক্ষুধাও পরিতৃপ্ত হয়।

বিশুদ্ধ বিনোদনে মন ও মনন বিকাশের মাধ্যমে শিশো কিশোরেরা উন্নত মানসিকতার দিকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক, এ প্রত্যাশা।


মোঃ নাজিম উদ্দিন
ডিসেম্বর ২০, ২০২১

লেখাটি লিখেছেন