ছোটবেলা দেখা গ্রামের প্রবীণ-নবীনের সম্পর্ক এবং একালের ভাবনা

Sep 3, 2020 | সুখী সংসার ও গুড প্যারেন্টিং | 0 comments

ছোটবেলার সব স্মৃতি সবসময় সবার পুরোপুরি মনে আসেনা- স্মৃতির প্রকৃতিই এমন- বিস্মৃত হওয়া- তারপরও যা স্মরণে থাকে তার জাবর কাটা অনেক সুখকর।
তাছাড়া, এককালের ক্রীড়াপ্রধান সমাজের পরবর্তী প্রজন্মের মোবাইল-ফেইসবুক অতি-নিমগ্নতা নিয়ে আজকের অবতারণা।

বয়স যখন ১২-১৩ বা ১৪ তখন দাদা আহমদুর রহমানের সাথে বিভিন্ন অনুষ্টানে যাওয়ার সৌভাগ্য হত। তখন বিয়ের পূর্ব রাতে মেহেদি অনুষ্টানের রাত কিংবা তারও পূর্বরাতে বা মেজবানের পূর্বরাতে সমাজের সবার উপস্থিতিতে অনুষ্টিত হত পান-চল্লা। এখনও পান-চল্লার প্রচলন সমাজে আছে। (সমাজ বলতে ২-৩ বাড়ির সমন্বয়ে গঠিত সামাজিক-ভৌগোলিক এলাকাকে বুঝায়)। তখন পান-চল্লায় প্রথমে আলোচনা হত কিভাবে পরের দিনের অনুষ্টান সামলানো হবে, কয়জন করে দাওয়াত দেয়া হবে(সামর্থ্যানুযায়ী), কে সকালে প্রত্যেক ঘরে গিয়ে দাওয়াত দিবে, কারা রান্না করবেন (বর্তমানে যা বাবুর্চির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়),কারা তদারকি করবেন, কারা খাবার প্রদান করবেন ( বিশেষত যুব-কিশোরগণ মিলে যে কাজকর্ম আন্তরিকতার সাথে সম্পাদন করতেন, তা অাজ বেতন-টিপস নিয়ে বয়-বেয়ারাগণ সম্পন্ন করে)..ইত্যাদি। অতপর চা-পান-সিগারেট (নাস্তা হিসেবে বিস্কিটের সাথে তৎকালিন ঝাঝ-পাক্কনের নাম উল্লেখযোগ্য) ইত্যাদি প্রদান। তারপর শুরু হত জমজমাট গল্প। আমাদের সমাজে তখন সর্দার ছিলেন আলহাজ্ব সুলতান অাহমদ (মোনাফ বাড়ির) -যিনি গান্ধী সুলতান নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। সবাই উনাকে খুব সম্মান করতো। সমাজ সর্দারের বক্তব্যের পর জমজমাট আলোচনায় সমাজের বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা, ভাল-মন্দ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলত অনেকক্ষণ।

আলোচনায় যাদের রম্যরসসমেত মজার গল্প এখনো মনে পড়ে তারা হলেন বানু হাজির বাড়ির প্রিয় বাদশা দাদা (মরহুম), মরহুম বোচা মিয়া (জা’নার বাবা বলে পরিচিত ছিলেন),তার ভাই নজমুল হুদা,  আলহাজ্ব মোঃ ইদ্রিস প্রমুখ। উল্লেখ্য, আজকের বয়-বেয়ারা ধারণাটি তখন ছিল না বলা যায়, কেননা, সামাজিক সংগঠন-ক্লাব ইত্যাদিই এসব কাজ আঞ্জাম দিতো আর তার বিপরিতে সামাজিক ধরা (যে অর্থ বরপক্ষ কর্তৃক কনেপক্ষকে দেয়া হত) তার একাংশ সে সব ক্লাবকেও দেয়া হত।

শীতের সকালে বা গ্রীষ্মের দুপুরে সুপরিচিত আড্ডাখানা ছিল বাদামতল। সেখানে প্রবীণ নবীনগণের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে গল্প, রম্য, কত দুষ্টামি- যাদের অামরা পেয়েছি- আলহাজ্ব গোলাফুর রহমান (মরহুম), নজমুল হুদা -সাবেক মেম্বার (মরহুম), বোচা মিয়া (মরহুম),নুরুল হুদা (মরহুম), বাদশা মিয়া (মরহুম), ইউসুফের বাবা (মরহুম), মানিক (মরহুম), সিরাজুল হক দাদা (মরহুম) প্রমুখসহ অারো অনেকে।

যুব-কিশোরগণ বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকতো। অতি বর্ষার কারণে বা মাঠে ধান লাগানো হলে চলত এক জায়গায় বসে বুদ্ধির কিছু খেলা, যেমন, বাঘ-পাইর, মোগল-পাঠান (যা বিকৃত হয়ে মঙ্গল-পাঠাননামেও খ্যাত ছিল), লুডু, ওজু (সোজা) পাইর, কড়ি খেলা, হাত গুত্তি খেলা ইত্যাদি। কৌশলে জয় লাভের এসব ইনডোর গেইমস বর্তমানে তেমন প্রচলিত না থাকলেও তখনকার সময়ে আমাদের কাছে খুব উপভোগ্য ছিল।

বিশেষ করে, হাতগুত্তি ছাড়া বাকি গেইম গুলো দাদা-চাচাদের সাথে খেলতাম, শিখতাম কিভাবে ঠান্ডা মাথায় তারা পরাজিত করতো নাতি-ভাইপোদের!
মাঠের খেলাগুলোতে ছিল ১২-১৩ বছরের কিশোর থেকে ৪৫-৫০ বছরের “যুবক-মাঝবয়সী”দের সানন্দ অংশগ্রহণ।
ফুটবল, পর খেলা (আধুনিক দাড়িয়াবান্ধা), ঘাডুডু ( অাধুনিক হাডুডু), ডাঙ-গোলা, বলি খেলা (আমাদের সময়ে প্রায় অপ্রচলিত ছিল),সাত-চেঁ’রা খেলা, ঢেঁকি খেলা, কৈতুর-বাচা খেলা, চিঁচি খেলা, এচকি মেচকি খেলা ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। তখনো ক্রিকেট জনপ্রিয় না হলেও ১৯৯২-৯৩ বা কাছাকাছি সময়ে ক্রিকেট বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ফলে বাড়ি-সমাজ-ছাড়িয়ে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির যুব-কিশোরগণের মধ্যে একদিকে যেমন দারুন প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি করত, অন্যদিকে সবার মধ্যে প্রকৃত সম্পর্কও সুদৃঢ় করত। আজ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় হারিয়ে গেছে “বিয়েতা-আবিয়েতা” (বিবাহিত বনাম অবিবাহিত),পোয়া-বুড়ো (যুবক বনাম বয়স্ক) ফুটবল ম্যাচের উত্তেজনা এখনো স্মৃতিতে অম্লান। ছিল আবাহনী-মোহামেডান তুমুল প্রতিযোগিতা!

এসব গেইমসে প্রবীণগণ ছিলেন আগ্রহী দর্শক। তাছাড়া বাজারে (রমজান আলি হাট) যাওয়ার পথে জারুলতলা-অাধারমানিক-লেলেংগারাবাসী পথিকগণ সময়ের ঘন্টা না দেখে খেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত (ফুটবলে যার নাম ছিল সন্ধ্যা গোল- যে গোল হলেই খেলা শেষ হত) খেলা দর্শন।।।

সে সব সোনালি দিনের বড় প্রয়োজন।

আজ যুব-কিশোরগণের সময় খুব কম-পড়ার চাপ, বৈষয়িক ব্যস্ততা ইত্যাদিতে সময় পাওয়া দুষ্কর, সত্য
তবে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ছোঁয়ায় ডিশ এন্টিনা, মোবাইল,ফেইসবুক, টুইটার হোয়াটসআপ, ভাইভারে “অধিক” নিমগ্নতা একদিকে যেমন কেড়ে নিচ্ছে আমাদের সময়, তেমনি শারিরীক উন্নতি, সৌহার্দ্য -বন্ধনবৃদ্ধিতে খেলাধুলা-আলোচনা ইত্যাদি অনেকাংশে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সহ সচেতন সমাজ এগিয়ে না আসলে সামনের দিনগুলো কেমন হবে, তা ভাবার সময় এসেছে।
আসুন, ভার্চুয়াল জগতের পাশাপাশি “প্রকৃত” সামাজিক যোগাযোগ সুদৃঢ় করি। পুনস্থাপন তরি অভিজ্ঞ প্রবীণদের সাথে নবীনদের সম্পর্ক।
—–

মোঃ নাজিম উদ্দিন
nazim3852@gmail.com
চট্টগ্রাম
২৫-০৮-২০১৮

লেখাটি লিখেছেন