এ আমার গ্রাম, আমাদের প্রাণ
একসময়ের ছোট একটি জনপদ। বিদ্যুৎ নেই। নেই টেলিফোন। নেই ইন্টারনেট। নেই যোগাযোগের সহজ সুবিধা। স্কুলে যেতে দু কিলোমিটার যেতে হতো প্রায়। প্রায় রাস্তা কাঁদাতে ভরপুর। নৌকা ছাড়া সব যোগাযোগ বন্ধ। কেউ কোথাও বেড়াতে গেলে অনেকদূর হেঁটে হয় নৌকার ঘাটে বা সদরে বাসে করে যেতে হতো। রিক্সা ছাড়া কয়েকটা টু স্টোক বেবি টেক্সি। অনেকদিন পর একটা কার দেখা যেতো। পালকি করে বধূ আসতো।
বর্ষায় প্রায় সব রাস্তায় পানি উঠে। বাড়ির সামনের বিলেও তখন নৌকা আসতো।
চাষাবাদ আর মাছ ধরা ছাড়া ছিলো দু একটা পেশা। শিক্ষকতা। রেঙুনে সারেং বা চাকুরি। কিছু লোক মধ্যপ্রাচ্য থাকতেন। গুটি কয়েক শহরে চাকুরি করতেন।
বিনোদন বলতে খেলাধুলাই। শুইল্ল্যার হারমোনিয়াম। মাঝে মাঝে ব্যান্ড পার্টি। তখনো টেলিভিশন সব বাড়িতে ছিলোনা। বিদ্যুৎই যেখানে মাত্র ঝিলিক মারা শুরু করেছে!
বিয়ের আগের রাতে পানচল্লা। আড্ডা। চলতো ঝাঁজ পাক্কন আর চায়ের ঝড়। বেইগ্গ্যা দাদা, বাদশা দাদা, ইদ্রিস জেটাদের জমজমাট আড্ডায় পানচল্লা গভীর রাত গড়াতো।
সামর্থ্যবানেরা মেহেদি রাতে ভিসিআর ভাড়া করে আনতেন। কয়েকবাড়ির কিশোর যুবা জড়ো হতো যথাসময়ে। উঠানে টিভি বসানো হতো। সে কী উত্তেজনা। মিটুন চক্রবর্তী অভিনীত একশন মুভি বা সমকালীন প্রিয় ‘আক্রোস’ সিনেমার কথা মনে আছে। একশন মুভি আমাদের সময়ের কিশোরদের খুব পছন্দের ছিলো। বরযাত্রীদের সাথে ছোটরা যেতে পারতো না সবসময়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হেঁটে যেতো বরযাত্রী। ধীরে ধীরে চাঁদের গাড়, জীপ, বাস, বরের জন্য সাজানো কার আসা শুরু হলো।
নিয়মিত আয়োজন ছিলো মেজবান। দরিদ্রসীমার কাছে থাকা কিছু গ্রামবাসির জন্য মেজবানই গরুর মাংস খাওয়ার অন্যতম উপলক্ষ ছিলো। তাই মেজবান মানেই আকর্ষণ, ভীড়। আনন্দও।
ছোটদের বসানো হতো ছপ/পাটি বিছিয়ে, নীচে। চেয়ার নাগাল পেতে করতে হতো অভিনয়। মাঝে মাঝে মেজবান হতো দু এক বাড়িতে। রফিক চেয়ারম্যানের বাড়ির মেজবান, বারিক মাঝির বাড়ির মেজবানে আমাদের উপস্থিতি ছিলো নিয়মিত। দূরত্ব কিছুই না তখন।
ধীরে ধীরে বিনোদনে ক্রিকেট আসলো। রেডিওতে ধারাভাষ্য শুনতাম। আসলো টিভি। ম্যাকগাইভার। আলিফ লায়লা। অয়োময়। সংশপ্তক। কান কাটা রমজান। মুনাফ বাড়ির শ্রদ্ধেয় আবচার মেম্বারের ঘরে বুধবার রাত ৯ টায় ম্যাকগাইভার দেখতে হাজির হতাম। প্রায় সব বাড়িতে বিদ্যুৎ আসলো। বিদ্যুত চলে গেলে শুক্রবার রাতে আলিফ লায়লার কোন অংশ মিস না করার জন্য দৌড় দিতাম রমজান আলী হাটের মোনাফ কোম্পানির ডেকোরেশনের দোকানে। ততক্ষণে অনেক ভীড়। সে কী আনন্দ! দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান দেখার পর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তলোয়ার বানাতাম। চলতো তলোয়ারের মক যুদ্ধ।
আবাহনি মোহামেডান ফুটবল যুদ্ধ। ছিলো বিবাহিত আর অবিবাহিত ম্যাচ। বর্ষায় পাইন্ন্যা খেলা। সন্ধ্যায় সন্ধ্যা গোল। ইফতার মাহফিল আর তারাবিহতে খাবার দেয়া হতো। মাফলিত হতো মাঝে মাঝে। জিলাপি আর বন ছিলো কমন খাবার।
অভাব সংকট লেগে থাকতো। তবুুও একে অপরের পাশে থাকতো সবসময়। সব আনন্দ যেমন একসাথে ভাগাভাগি হতো, সব দুঃখেও পাশাপাশি ছিলো গ্রামবাসি, প্রতিবেশি। সকল অভাবেও ছিলো প্রশান্তির হাসি। ভালোবাসাবাসি।
এসব যেন এইতো সেদিনে ঘটনা। আমাদের শৈশবের এসব দৃশ্য। আর এসব দৃশ্যের মঞ্চপট আমাদের বাড়িঘর। সামনের মাঠ। দক্ষিণের মাঠ। এ মাঠ বিল কখনো ধানে ধন্যে পুষ্পে ভরা, কখনো বন্যায় সমুদ্র সৈকতের আবহ, কখনো রৌদ্রোজ্জ্বল খেলার মাঠ বা পশুর চারণভূমি। এ যেন আমার প্রিয় গ্রাম মোহাম্মদপুরের দৃশ্য নয়, এ যেন রূপসী বাংলা। ৫৫ হাজার বর্গমাইল। ৬৪ জেলা। প্রিয় বাংলাদেশ।
কবির ভাষায়,
“এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী–জননী।
ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবনি।
রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল,
আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জৈষ্ঠে মাতাও তরুতল।
ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল ল’য়ে অশনি।।
এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী–জননী।”
ছোট ভাই মনিরের তোলা ছবিগুলো দেখে সত্যি স্মৃতিকাতর হয়ে গেলাম। ফিরে গেলাম স্মৃতির বন্দরে। এইতো আমার মাঠ। আমার শৈশব। আমার প্রাণ। এ মাঠের মাটির গন্ধ মিশে আছে আমার সারা হিয়া। আমার সমস্ত অন্তর।
জীবন জীবিকার কারণে গ্রামের অপরূপ এ মাঠ ঘাটের দৃশ্য সময় করে উপভোগ করা হয়না। এ জীবন কোন জীবন নয়। ইট পাথরে বাঁধা এ নাগরিক কয়েদখানা যেন। WH davies এর ভাষায়
“What is this life if, full of care, we have no time to stand and stare?”
এ গ্রামে আমাদের প্রাণ। এ গ্রামে বাঁধা আমাদের স্মৃতি, শেকড়, শৈশব।
এ গ্রামের বিশুদ্ধ আলো বাতাসের টান ফিরে আনুক আমাদের হৃদয়ের প্রাণ।
—
মোঃ নাজিম উদ্দিন
জুলাই ১২, ২০২১
(ছবিগুলো মনিরের তোলা)