গ্রামে ইফতার-সেহেরি: বাল্যবেলার কতকথা
পবিত্র রমজান সংযম, সংকল্প ও ধর্মীয় কাজে আমাদের এক বিরল প্রশিক্ষণে নিয়োজিত করে। তবে এ রমজান আমাদের শুধু ধর্মীয় আবহই নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরও অংশ। আমাদের বাল্যকালে দেখা যেতো, এ রমজান মাস জুড়েই চলতো একদিকে সংযম, এবাদত আর প্রাক্ ঈদ প্রস্তুতি, অন্যদিকে শিশু, কিশোর এবং বাড়ির মহিলাগণের নানা আয়োজন, নানা প্রস্তুতি।
আমাদের শৈশবের ইফতার এক বর্ণিল অধ্যায়। বয়স যখন ৮/১০, তখন রোজা না থাকলেও ইফতারের সময় ব্যস্ততা ছিলো এ সব ‘বেরোজাদার’দের বেশি! ইফতারের পূর্বে যেতে হতো টিউবওয়েল থেকে পানি আনার কাজে। তখন আজকের মতো প্রতি ঘরে ঘরে টিউবওয়েল ছিলোনা। ফ্রিজও ছিলোনা প্রায় অনেক ঘরে। গরম কালের রমজানে বাজার থেকে বরফ কিনে আনতে হতো, ঠান্ডা শরবত খাওয়ার তাগিদে। শরবত ছিলো মূলত, লেবু আর চিনির সংমিশ্রণে। মাঝে মাঝে রুহ আফজাহ বা ট্যাংও দেখা যেতো। ঘরে ইফতারে ভাইবোনের সাথে ঝগড়া ছাড়া তেমন বৈচিত্র্য ছিলোনা। মসজিদে নামাজের পর একসাথে ইমাম ও মুসল্লিদের সাথে ইফতার করার উদাহরণও কম নয়। বিভিন্ন ঘর থেকে বাহারি ইফতারি ইমাম মোয়াজ্জিন দের জন্য পাঠানো হতো বাদ আসর থেকেই।
তবে ক্লাব, সংগঠন, কয়েক ঘর মিলে বা বাড়ির সবাই মিলে ‘ইফতার পার্টি’র আয়োজন ছিলো আকর্ষণীয়। বন্ধুদের মধ্যে কে কয়টা রোজা রেখেছে- তা নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতা। তবে বয়োজ্যেষ্ঠরা আমাদের অবুঝ কৈশোরে দুষ্টুমি করে বলতো- কলা গাছে কামড় দিয়ে রোজা জমা রেখে ইচ্ছেমতো খেয়ে নিয়ে, খাবার শেষে আবার কামড় দিয়ে রোজা ফেরত নিতে শেখাতো- তখনো জানতাম না – এ ছিলো নিছক দুষ্টামি! মাঝে মাঝে বাড়ির কাছে বা দূরের আত্মীয়দের ঘরে তৈরি ইফতারি নিয়ে যেতে হতো: শৈশবে সে ইফতারি থেকে নিজেরা কিছু খেয়েও ফেলেছি কতবার!
ইফতারের আগে কোরআন পড়া হতো নিয়মিত। তবে সময় কাটানো জন্য কেরাম, লুডু, পর খেলা, মেয়েদের চুট্টি (ময়দা দিয়ে নাস্তা বানানোর উপকরণ) কাটার দৃশ ছিলো সহজাত।
এদিকে, ইফতার পার্টির দিন সকাল থেকেই সবার সে কী ব্যস্ততা!
বেশির ভাগ সময়ে, নিচে পাতলা কার্পেট (ছপ) বা শীতল পাটিতে বসে সারিবদ্ধভাবে সবাই একসাথে ইফতার করা ছিলো বৈশিষ্ট্যময়। আয়োজনে প্রায়শই থাকতো শরবত, খেজুর, চনাবুট, পেঁয়াজু, বেগুনি, মরিচ্চ্যা, মুড়ি, কলা, জিলাপি, মাঝে মাঝে ফিরনি, বাংলা সেমাই বা নুডু্লস, হালিমও থাকতো। সব আয়োজন যখন প্রস্তুত, এবার মাগরিবের জন্য অপেক্ষা: তখন খুব কম মসজিদেই মাইকে আজান দেয়া হতো: মাঝে মাঝে সাইরান দেয়া হতো! আজান দেয়ার সাথে সাথে পিনপতন নিরবতা। তখনকার অভাবের যুগে খাবারের সংস্থান যেহেতু কম ছিলো, অপচয়ও ছিলো কম: হয়তো অনেকে ইফতার পার্টিতেই কিছু বিশেষ আইটেম খাওয়ার সুযোগ পেতো। অভাব ও সংকট কেমন ছিলো তা বুঝা যায়- দাওয়াত ছাড়াও অনেকের উপস্থিত থাকা থেকে।
এরপর শুরু হয় তারাবিহের দৌড়। খতম তারাবিহ আর সুরা তারাবিহ- এ দুয়ের মধ্যে সময় বাঁচানোর জন্য সুরা তারাবিহর নামাজে যোগ দিতাম। তবে যেদিন খতম তারাবিহর মুসল্লিদের নাস্তা বা খাবার (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা হতো সেমাই, চটপটি বা মিষ্টান্ন) দিবে- এ ‘খবর’ পেলে সেদিন সময় বেশি গেলেও ‘খতম তারাবিহর’ মসজিদে যেতাম দল বেঁধে।
রাত পার হলেই সেহেরি। এবার সেহেরিতে উঠতে হবে। রাত ৪ টায় সেহেরির শেষ সময় হলে রাত ৩ টা হতে মাইকে ডাকাডাকি শুরু হয়- ‘সেএরি হাইবের সম অইয়্যি- অনরা উডি ডঅন গুই… (সেহেরি খাবার সময় হয়েছে: আপনারা উঠে যান)। এভাবে সেহেরির শেষ সময়ের প্রায় শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত মাইকে ডাকা হতো, দেয়া হতো সাইরেনও। ঘুমু ঘুমু ভাবে সেহেরি শেষে মসজিদে যেতাম সব বন্ধু মিলে।
এবার রোজা শেষে চাঁদ উঠার অপেক্ষা। ২৯ রোজার দিন সংশয় থাকলেও ৩০ রোজার দিন হয় চুড়ান্ত আনন্দ: যেন ঈদের আগেরদিনই চুড়ান্ত আনন্দ। সমাজের মসজিদে যিনি এত্তেকাফ থাকেন, তাঁকে সসম্মানে তকবিরের সাথে মিছিলের মাধ্যমে ৩০ রোজার দিন বাদ আসর এত্তেকাফাকারীকে ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে শেষ রোজা সমাপ্ত হয়
অতপর চাঁদ উঠলে সচক্ষে চাঁদ দেখে রমজানের মধুর বিদায়। নজরুলের সেই বিখ্যাত গান ‘এ মন রমজানের ওই রোজা শেষে এলো খুশীর ঈদ’ বেজে উঠতো বিটিভিতে। বলা শুরু হতো ‘আজিয়্যে রোজা, হালিয়ে ঈদ:.. হান্দে ফিত ফিত (আজ রোজা, কাল ঈদ,…. কাঁদে ফিত।ফিত)- এ শ্লোক দিয়ে আমাদের দু্ষ্টুমির মাত্রা বাড়তে থাকতো।
এভাবেই কাটতো রমজানে মধুর শৈশব, কৈশোর। অভাব ছিলো, সংকট ছিলো, সীমাবদ্ধতা ছিলো, কিন্তু এ সবের চেয়ে বেশি মাত্রায় ছিল ভ্রাতৃত্ব, বন্ধন আর সৌহাদ্য। মুঠোফোনে গেইমস বা কার্টুন দেখার আজকের প্রজন্ম এ নিখাদ শৈশব কি কখনো ফিরে পাবে?
—–
মোঃ নাজিম উদ্দিন