সাপে কামড় বা সর্প দংশনঃ জেনে নিন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য- থাকুন সাবধানে
ডাঃ মোঃ মোজাম্মেল হোসেন
———
সম্প্রতি সাপের কামড়ে মৃত্যুঝুঁকিসহ বিভিন্নভাবে আহত হচ্ছে গ্রামের অধিবাসীসহ বিভিন্ন এলাকায় আক্রান্ত হচ্ছেন বহু মানুষ। এ অবস্থায় সচেতনতা জরুরী, জরুরী প্রয়োজনীয় সাবধানতা। এ নিয়ে আজকের অবতারণা।
স্বাস্থ্য অধিদফ্তর কর্তৃক আয়োজিত ‘Orientation On Snake bite Management’ শীর্ষক এক অনলাইন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে জানা যায় দেশে প্রতিবছর আনুমানিক ছয় লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন, সাপের কামড়ে মারা যায় প্রায় ছয় হাজার মানুষ এবং অনেকে পঙ্গুত্ব বরন করেন।
বাংলাদেশে পাঁচ প্রজাতির বিষাক্ত সাপের দেখা পাওয়া যায়:
১) কোবরা(Kobra) বা গোখরা সাপ : তিন ধরনের গোখরা আছে-
** মনোসিলেট (Monocellete)কোবরা : ফণাতে একটি ফুল থাকে এবং সারাদেশে পাওয়া যায়।
** বাইনোসিলেট (Binocellete) কোবরা : ফণার দুইপাশে ফুল থাকে, সারাদেশে পাওয়া যায়।
** কিং (King)কোবরা : ফুল অর্ধেক করে দুই পাশে থাকে, সাধারণত সুন্দরবনে পাওয়া যায়।
২) ক্রেইটস (Kraites): সারাদেশে পাওয়া যায়। পুরো শরীরে ব্যান্ড থাকে।
৩) রাসেল’স ভাইপার ( Russell’s Viper):
রাজশাহীতে পাওয়া যায়। ধানক্ষেতে পাওয়া যায়।
৪) সি স্নেক (Sea Snake): সমুদ্র অঞ্চলে পাওয়া যায়। পটুয়াখালী ও কক্সবাজারে দেখতে পাওয়া যায়।
৫) গ্রীন পিট’স ভাইপার (Green Pit’s Viper) :
সবুজ রংয়ের, গাছের ডালে পাতার সাথে মিশে থাকে।
কোবরা বা গোখরা এবং ক্রেইট সাপের কামড়ে মৃত্যুর হার বেশি। গ্রীন পিট ভাইপার গাছে থাকার কারনে মুখ এবং মাথায় দংশন করে। কোবরা সাধারণত পায়ে, ক্রেইট শরীরের যেকোনো জায়গায়, সাগরের সাপ সাধারণত হাতে দংশন করে। সাপ নিশাচর প্রাণী তাই রাতে কামড়ের হার বেশি।
বিষাক্ত সাপের দংশনের কিছু লক্ষণ থাকে, যেমনঃ
১) প্রথমে আমরা কামড়ের দাগ লক্ষ্য করলে দেখব দুটো দাঁতের মার্ক বা চিহ্ন। কিন্তু অবিষাক্ত সাপ হলে কয়েকটা দাঁতের চিহ্ন থাকবে।
২) দংশনের স্থানে তীব্র ব্যাথা, ফোলা, লালচে হয়ে যাওয়া, আস্তে আস্তে আক্রান্ত স্থান কালো হয়ে যাওয়া, ফোস্কা উঠে এবং তা ফেটে গিয়ে ইনফেক্টেড হয়ে যাওয়া, অনেক সময় পঁচে ( Gangrene) যায়।
**চোখে ডাবল (Double) দেখা (Diplopia), চোখে ডুলু ডুলু ভাব (Ptosis)।
৩) ঘাড়ের মাংসপেশীর অসাড়তার কারনে ঘাড় সোজা করে রাখতে না পারা (ব্রকেন নেক সাইন)।
৪) কন্ঠস্বর পরিবর্তন হয়ে যাওয়া / নাকি কন্ঠ
৫) মুখ খুলতে না পারা, জিহবা নাড়তে না পারা
৬) শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে জড়িত মাংসপেশীর অসাড় হয়ে যাওয়ার কারনে শ্বাস নিতে না পারা
৭) দংশনের স্থান থেকে, দাঁতের মাড়ি থেকে অনবরত রক্ত পড়া। রক্তবমি করা, প্রশ্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া, প্রশ্রাবের পরিমান কমে যাওয়া, মাংসপেশীর কাঁপুনি (Muscle Twitching) হওয়া।
৮) এছাড়াও ঘাম, বমি, পাতলা পায়খানা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি হওয়া, কিডনী ফেইলিউর হয়া।
সাপের কামড়ে করণীয় :
সাপ কামড় দিলে আতংকিত না হয়ে দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়ার পূর্বে কিছু ব্যাবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আগে সাপে দংশন করলে সুতা দিয়ে খুব শক্ত করে বেঁধে দিত। বর্তমানে এই শক্ত বাঁধাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে কারন শক্ত করে বাঁধার কারনে দেখা যায় রক্ত চলালচল বন্ধ হয়ে পঁচন ধরে অঙ্গহানি ঘটে।
তাই সাপ যদি পায়ে দংশন করে তাহলে তাকে হাঁটা নিষেধ করতে হবে কারন এতে বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে তার পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ অথবা স্প্লিন্ট (হাড় ভাঙ্গলে যেভাবে ব্যবহার করে) দিয়ে কোলে বা গাড়ি করে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। হাতে কামড় দিলে হাতের নড়াচড়া নিষেধ প্রয়োজনে স্লিং দিয়ে হাত ফিক্সড করে হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
হাসপাতালে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন করবেন।
সাপ প্রকৃতির দান, একে মেরে ফেলা ঠিক নয়। আল্লাহ তায়ালা তার কোনো সৃষ্টিকে বিনা কারণে দুনিয়ায় পাঠাননি। সাপ প্রকৃতির বর্জ্য শোধন করে। ধানক্ষেতে ইঁদুর নিধন করে ফসলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
সাপের কামড় প্রতিরোধযোগ্য ও চিকিৎসাযোগ্য তাই ওঁজা, কবিরাজ, দংশন স্থানে ব্লেড দিয়ে ক্ষত না করে, লতাপাতা ব্যাবহার না সময় নষ্ট না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন, এতে বেঁচে যাবে জীবন।
সাপের দংশন প্রতিরোধে করণীয় :
১) বাড়ি ঘরের আশেপাশের ময়লা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, খালি পাত্র ঢেকে রাখা। বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখতে হবে। সাপ সাধারণত খাবার সন্ধানে বাসাবাড়িতে প্রবেশ করে। তাই যত্রতত্র খাবার যাতে পড়ে না থাকে।
২) রাতে বাসা থেকে বের হলে হাতে টর্চলাইট নিয়ে বের হতে হবে।
৩) বাচ্চারা মাঠে খেলতে গেলে খেলার সু বা জুতা পড়ে যাবে। বল বা অন্য কিছু ঝোপঝাড় থেকে নিতে গেলে আগে কোনো লাঠি দিয়ে ঝোপঝাড় শব্দ করে নিশ্চিত হয়ে নিবে।
৩) ক্ষেতে বা মাঠে কোনো গর্তে হাত ডুকাতে নিষেধ করতে হবে।
৪) কখনো সাপ দেখলে একে তাড়া বিরক্ত না করে চলে য়াওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
সাপ নিরীহ প্রানী। এরা মানুষ বা অন্যান্য প্রানীকে ভয় পায়। তারপরেও অনেকসময় দূর্ঘটনা ঘটে যায়।
বর্তমানে অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ জেলা সদর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে বিষাক্ত সাপের দংশনের এন্টিভেনম সরবরাহ আছে।
তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন সুস্থ থাকুন। সতর্ক থাকুন।
—
ডাঃ মোঃ মোজাম্মেল হোসেন
এমবিবিএস, বিসিএস
মেডিক্যাল অফিসার
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।