ভাবনার সাতকাহন

Jul 4, 2025 | গল্প প্রবন্ধ উপন্যাস | 0 comments

View : 1
 

ভাবনার সাতকাহন 

কেউ যখন কোন কিছু লিখতে বসে, মনের অনেক ভাবনারাশির দৌড় প্রতিযোগিতায় মধ্যে যেটি সবার আগে আসে, সেটিই প্রতিষ্ঠিত হয় লেখনীতে। এজন্যই হয়তো নও-লেখকদের ক্ষেত্রে প্রচেষ্টায় ছন্দপতন মুহুর্মুহু লেগেই থাকে; হয়তো প্রসিদ্ধ লেখকদের ক্ষেত্রেও এ অভিজ্ঞতা থাকবে না এমন নয়। অর্থাৎ যেটি লিখতে মনঃস্থির করেছি, তা কখন যে চাপা পড়ে গেছে তা বুঝতেই পারেনি।

একটি ক্ষুদ্র জীবনকাল নিয়ে ধরাধামে মানুষ অবতরণ; যে শতায়ু ব্যক্তি তার জন্য শতবর্ষ সময়ের স্মৃতি যেন এক পলকে চলে যায়; কৈশোরের স্মৃতি রোমান্থনে তিনি বলেন, এইতো সেদিন, কিশোর থেকে কিশোরে পদার্পণ করেছিলাম। এভাবে স্মৃতির অংশ তার তারুণ্য ধরে রাখে। অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই। মূলতঃ এই সুন্দর ধরণীতে কেউ কখনো নিজেকে প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ ভাবতে চান না। শতায়ুগণ চান ডাবল সেঞ্চুরি করতে, হয়তো কারণ, এ পৃথিবীর মায়া জাল ছেড়ে কে-বা যেতে চান পরপারে? যেন “মরিতে চাহিনা অামি সুন্দর ভুবনে”..

তবে ব্যতিক্রম আছে; কতক মুষ্টিমেয় আধ্যাত্মিক সাধক সাধনার সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে মালিকের সাথে সাক্ষাতের প্রথম শ্রেণী হিসেবে মৃত্যুর স্বাদ নিতে মরিয়া হয়ে পড়েন; সে এক বিরল ভাবনা, অদ্ভুদ আত্মতৃপ্তি; তাঁরা ভাবেন অারেক লাইনে; সর্বদা খোদার ভয়ে তটস্থ উচ্চশ্রেণীর মুত্তাকীদের ভাবনাবিশ্ব কি আমরা সাধারণের অানন্দে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টার সাথে মিলবে? তাঁদের রয়েছে সাধনা অার অতৃপ্ত অনুশোচনা; প্রতি মুহুর্তেই কাজে শতভাগ লাগানোর প্রচেষ্টার মাঝে তাঁদের দিবানিশি…

বিদগ্ধ লেখক হুজ্জাতুল ইসলাম
হযরত ইমাম গাজ্জালী (রঃ) তাঁর “মিনহাজুল আবেদীন” গ্রন্থে লিখেছেন, “…. তার উপর আবার মানুষ খুব দুর্বল, কালচক্র কঠিন; দিনের কাজ বিস্তর; কিন্তু অবকাশ কম; কর্তব্যকর্ম অনেক, কিন্তু পরমায়ু ক্ষীণ। এই ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে ইবাদত আর দ্বীনের কাজ যতোটুকু যাই-বা হচ্ছে, তাতে ত্রুটির অন্ত নেই। পক্ষান্তরে, যার কাজ ও যিনি তার হিসাব নেবেন, তিনি ভারী সচেতন ও সুক্ষদর্শী। সফল সুদীর্ঘ কিন্তু মৃত্যুর বিভীষিকা সমাগত। এ সফরে ইবাদতে এলাহীর একমাত্র সম্বল। দ্বিতীয়তঃ পাথেয় নেই এ দীর্ঘ সফরে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে প্রতি পলে পলে। যা বিগত হয়েছে তা অার ফিরে পাবার নয়। সুতরাং এরই মধ্যে যে জন সঞ্চয় করেছে, সে জনই কেবল সফলতা লাভে সক্ষম হয়েছে।”

কর্মের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে কর্মময় জীবনের সমগ্রটাই তারুণ্যের শক্তিতে, ভাবনায় ও ধ্যান-ধারণায় কাটিয়ে দেয়ার মাঝেই সফলতার বীজ নিহিত; যে যৌবন মনে স্থায়ী বসবাস করে, তাকেই কর্মের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে, তা কখনো বয়োপ্রাপ্ত হয়না। তবে যারা নিজেদের বৃদ্ধ বা প্রৌঢ় ভাবে, তাদের কাছে অনেক আশা দুরাশা।
কবি শেখ সাদী (রঃ) তাঁর ”গুলিস্তা ও বোস্তা” গ্রন্থে লিখেছেন,

“ধররে নওজোয়ান জে পীরর মজুয়ে কে দিগার না আয়েদ্ আবে রফতা বুজায়ে
জরয়ারা চুঁ রছীদ ওয়াক্তে দরুদ
না খারামাদ্ চুঁনাকে ছবজায়ে নও”।

অর্থঃ যুবকদের মত খুশি বৃদ্ধদের নিকট আশা করো না। কেননা যে পানি চলে গেছে, তা অার নদীতে ফিরে আসবেনা। শস্য যখন কাটার সময় হয়, তখন তার নতুন ফসলের ন্যায় দোল খায় না”।

এ সাধন করার সময় পার করে ফেললে যে কোনো ক্ষেত্রেই সফলতা লাভ বৃথা। তা সে এ ভবজগতের হোক বা দুই জগতের সমীকরণই হোক; কৃতকাজ বা যাপিত জীবনের কার্যকলাপ নিয়ে অনুশোচনা করার চেয়ে বর্তমানকে কাজে লাগানোতেই নিহিত সার্থকতা।

বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে জল-স্থল-অন্তরীক্ষে; ভূলোক-দ্যুলোক সর্বত্রই একনিষ্ঠতা, প্রবল ইচ্ছাশক্তি, অদম্য মনোবল আর অধ্যবসায় যে কাউকে নিয়ে যেতে পারে তার ইস্পিত লক্ষ্যে।

জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো- এ বুলি আওড়াতে-আওড়াতে জীবনের প্রভাত পার করেছি স্কুল জীবন স্কুলগামীরা; একজন জেলের ছেলে জেলে হবে, একজন পিতৃমাতৃহীন অনাথ সন্তান কিছুই হবে না- এ মানসিকতা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে অনেক দূর এগিয়েছে মানুষ।
এক পেশার লোক আরেক পেশার বিষয়ে জানছে। ৩৫ এর অধিক ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারতেন ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। একজন বিচারক হয়েও বিচারপতি হাবিবুর রহমান পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করেছেন পূর্ণাঙ্গ; তাছাড়া ‘কোরানসূত্র’ নামে এক দারুন গ্রন্থ রচনা করেন; ঐকান্তিক অাগ্রহ আর বহুমুখী সাধনা ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
বিস্ময়কর প্রতিভা দ্বারা মানুষকে এ পৃথিবীতে পাঠানো হলেও তার সম্পূর্ণটা ক’জনই ব্যবহার করতে পেরেছে? ক’জনই হয়েছেন অাইনস্টাইন?
মানুষ তার ক্ষমতা অার প্রতিভার বিশালতার কথা কি জানে?

”What a piece of work is a man! How noble in reason, how infinite in faculty! In form and moving how express and admirable! In action how like an angel, in apprehension how like a god! The beauty of the world. The paragon of animals. ”

HAMLET নামক নাটকে কত সুন্দর করেই অাজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর অাগে নাট্যকার William Shakespeare বলে গিয়েছেন!

জীবনের দূর্গমগিরিসমূহ আর কান্তার মরুভূমি রাত্রি নিশিতে পার করার জন্য নেমে পড়ার নামে সাধনা; ‘Man can be destroyed, but not defeated”. জীবনের উত্থান – “…to strive, to seek, to find and not to yield’ (Alfred Tennyson)- এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যাত্রাপথে রুদ্ধ হয় না কোন আবেগে; “And miles to go before I sleep” (Robert Frost) পংক্তিগুলো যেন স্মরণ করিয়ে দেয় হার না মানা জীবনসৈনিকে কথা, যাদের কারণে প্রস্তর, নব্য প্রস্ত যুগ থেকে মানুষ সভ্যতার এ শিখরে অাজ।

‘যদি’ এর প্রশ্নে কান্ত হয়ে “Had we World enough and Time” বলে Andrew Marvell এর খেদোক্তি যেন সকল কবি সাহিত্যিকদের ভাবের একাংশ; ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন, সময়ের একফোঁড়, অসময়ের দশফোড়- অনির্ধারিত অায়ুষ্কালে নিজের থলেতে কি পরিমাণ বোধশক্তি, স্থায়ী পুন্য বা কতদূর অভিজ্ঞতা লব্ধ করা গেলো- তাতেই পূর্ণাঙ্গতা। তবু অপূর্ণতা অার অপূর্ণাঙ্গতা থেকেই যায়।

“সব মানুষের জীবনে অপূর্ণতা থাকবে। অতি পরিপূর্ণ যে মানুষ তাকে জিজ্ঞেস করলে সেও অতি দুঃখের সঙ্গে তার অপূর্ণতার কথা বলবে। অপূর্ণতা থাকে না শুধু বড় বড় সাধক আর মহাপুরুষদের”। হুমায়ূন আহমেদ।

জীবনের এমন নিরলস যুদ্ধে সংশপ্তক বা বিজয়ী বেশে চূড়ান্ত সীমায় এগিয়ে যাওয়া জীবনের সফলতা, সার্থকতা।

আর তাই শেষ কথা আপনার সময়ের কদর করুন। সময় যে কত মূল্যবান কত দ্রুত ধাবমান সে সম্পর্কে সচেতন হোন। প্রচেষ্টা, সাধনা অব্যাহত রাখুন। জীবনের সার্থকতা মানে সাফল্য নয়, সার্থকতা নিহিত জোর প্রচেষ্টার মাঝে।

————–

নাজিম-০৪-০৭-২০২০