ভাদ্র মাসে কৃষিকাজঃ স্মৃতিকথা: কৃষক সমাজের কীর্তিগাঁথা
——
‘ভাদঅ মাইস্স্যা হাম, ওস্তাদি হাম”- (ভাদ্র মাসের কাজ, খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ)..যারা কৃষিকাজে নিয়োজিত, তাদের জন্য শ্রাবণ ভাদ্র মাসসমূহ সত্যি গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষিপ্রধান এ দেশে প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে সফলভাবে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের হিসাবে, দেশে গত ২০১৯–২০ অর্থবছরে ৫ কোটি ২৬ লাখ টন ধান উৎপন্ন হয়েছে, যা বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ। চীন ১৪ কোটি ৮৫ লাখ টন উৎপাদন করে প্রথম, আর ভারত ১১ কোটি ৬৪ লাখ টন উৎপাদন করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
(সূত্রঃ প্রথম আলো: মার্চ ২৭, ২০২১)
এ ধান উৎপাদনে আউষ, আমন ও বোরো ধানের মধ্যে আমন ধানের উৎপাদন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রকারভেদ অনুযায়ী আমন ধান রোপনের সময় হচ্ছে প্রতিবছর ১৫ জুলাই-১৫ আগস্ট বা ২৫জুলাই- ২৫আগস্ট। বাংলা মাস অনুযায়ী শ্রাবণ-ভাদ্র।
আর এ সময় থাকে বর্ষাকাল। বিলে থাকে পানি। মাছ। এরই মধ্যে বীজতলায় ধানের বীজ ফেলা হয়। প্রায় হাঁটু পানির মধ্যেই ধানের চারা মূল জমিতে বপনের জন্য তোলা হয়।
এ সময়ের প্রতিটি কাজের মধ্যেই শেখার থাকে অনেক কিছু। বীজতলা তৈরি, বীজধান ফেলা, যত্ন, পরিণত চারা তোলা, মূল জমি লাঙল বা ট্র্যাক্টর দিয়ে বপনোপযোগী করা, পরিণত চারা তোলা, বেঁধে মূল জমিতে নিয়ে যাওয়া এবং ফাইনালি বপন করা- এ সব কাজ শেখার তাগিদ থাকে।
আমাদের ছোটবেলায় এসব শেখার জন্য আমাদের থাকতে হতো মাঠে। ধানের কাজে যে ক’জন কৃষিকর্মী কাজ করতো, তাদের সাথে দাদা বা বাবার নির্দেশে আমাদের থাকতে হতো খুব ভোর থেকেই। সূর্য ওঠার সাথে সাথে কৃষিকর্মীদের সাথে যেতে হতো মাঠে। দাদা বলতেন, কর্মীদের সাথে ঘরের কেউ থাকা মানেই একজন কর্মীর সমান কাজ হওয়া। ধীরে ধীরে কাজ শেখা হতো। স্কুলের সময় হলেই মাঠ থেকে উঠে আসতাম।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিলো, কৃষিকাজে কর্মীদের সাথে মাঠে হাঁটু পানিতে একসাথে খাবার গ্রহণ। বেশিরভাগ সময়েই কৃষিকাজে নিয়োজিত কর্মীরা তিনবেলা ভাত খেতো। অবশ্য তখর গ্রামাঞ্চলে ভাতই ছিলো প্রধান খাবার। সকালে ছিলো মূলত পান্তা ভাত। দুপুরের খাবার বাড়িতে এসেই খেতে হতো। তরকারি হিসেবে ছিলো পোড়া মরিচ, লবন, কাঁচা মরিচ, কখনো পাকা কাঠাল, সবজি, শুটকি বর্তা ইত্যাদি।
সবশেষে পান আর বিড়ি (তখন আবুল বিড়ি বা কাড়িগর বিড়ি খুব প্রসিদ্ধ ছিলো).
খুব ভোরে চা খেয়ে কৃষিকর্মীরা মাঠে চলে যেতো। ২/৩ ঘন্টা কাজ করে তারা সকালের ভাত খেতো। আমাদের দায়িত্ব ছিলো বাড়ি থেকে ভাত, পানি, তরকারি নিয়ে মাঠে যাওয়া। ঘর থেকে খেয়ে যেতে বললেও আমাদের খুব ইচ্ছা থাকতো মাঠের কর্মীদর সাথে খাওয়ার। অগত্যা দাদি আমাদের খাবারও তাদের খাবারের সাথে দিতেন।
মূলত, বাড়ি থেকে দূরের কৃষিজমি।থেকে সবাই বাড়ি এসে খেলে সময় বেশি লাগতো বলেই কৃষিজমিতেই খাবারের ব্যবস্থা করা হতো।
খাবার বহনের কাজে ব্যবহৃত হতো বড় গামলা, খাবার পাত্র ইত্যাদি। কাপড় দিয়ে বিশেষভাবে বেঁধে দেয়া হতো। আর সবার উপরে কাপড়ে মুড়ে কিছু লবণ দিতে হতো।
মাঠের সর্বত্র তখন পানি। কোথাও হাঁটু পানি। কোথাও উরু পরিমাণ পানি। পানিময় জমি পাড় করে বেশ কষ্টে সব বহন করে পৌছাতাম আমরা। ধানের চারার স্তুপ, কমপানিতে জমির আইল ইত্যাদিতে খাবার রেখে খাওয়া হতো। বেশি পানিতে ভাবার প্লেইট হাতে রেখেই খাবার সমাপাত করা হতো। খাবারের মেনু বা ভেন্যু খুব আকর্ষণীয় ছিলোনা সত্যি, কিন্তু পরিশ্রমী ও ক্ষুধার্ত কৃষিকর্মীদের কাছে সে খাবার থাকতো অমৃতের মতোই।
খাবার শেষে তাদের সন্তুষ্টির ঢেকুরই বলে দিতো তাদের আনন্দ।
আর আমাদের তুষ্টির তো সীমা থাকতো না।
এক সময়ের “ভিক্ষার ঝুলি” উপাধি পাওয়া প্রিয় মাতৃভূমি আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এ সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এসব খেচমটে খাওয়া কৃষি কর্মীদের। তারা অনেক সময় এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায়, এক জেলা থেকে আরেক জেলায় গিয়ে কাজ করে থাকে। নতুন পরিবেশে তাদের খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা সত্যি বিস্ময়কর। তারাই দেশের Unsung heroes. সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার মূল কুশীলব।
আর আমরা যারা কৃষক পিতার সন্তান, কৃষক দাদার নাতি এবং এককালের গর্বিত কৃষক, তাদের কাছে কঠোর পরিশ্রম করে সোনার ধান বাড়িতে আনা পর্যন্ত ঘর্মাক্ত কৃষকের সকল কষ্ট আর সাধনাকে দেশমাতৃকার সবচেয়ে বড় সেবা মনে হয়। স্যালুট সেসব কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের। আজ এ বৈশ্বিক সংকটে রেমিটেন্স, গার্মেন্টস সেক্টর আর কৃষিখাতের মাধ্যমেই এতো ছোট দেশের ১৬ কোটি প্লাস মানুষ অভুক্ত পর্যায় থেকে অর্ধভুক্ত, তৃপ্তভুক্ত পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে।
কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণীর বিখ্যাত “চাষী” কবিতার কয়েকটি লাইন উল্লেখ করতে চাইঃ
“সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।
দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিল বড়?
পুণ্য অত হবে নাক সব করিলে জড়।
মুক্তিকামী মহাসাধক মুক্ত করে দেশ,
সবারই সে অন্ন জোগায় নাইক গর্ব লেশ।
ব্রত তাহার পরের হিত, সুখ নাহি চায় নিজে,
রৌদ্র দাহে শুকায় তনু, মেঘের জলে ভিজে।
আমার দেশের মাটির ছেলে, নমি বারংবার
তোমায় দেখে চূর্ণ হউক সবার অহংকার।”
—
মোঃ নাজিম উদ্দিন
জুলাই ২৬, ২০২১
শ্রাবণ ১১, ১৪২৮