নবান্ন আমাদের কৃষি প্রধান দেশের অন্যতম বৃহৎ উৎসব; সারা মৌসুমের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর কৃষাণ-কৃষানীর মুখে অমলিন হাসি, বাঁধভাঙা আনন্দ যেন ভুলিয়ে দেয় প্রাপ্তির দারুন সুরে।
আমরা যারা গ্রামে বাল্যকাল পার করেছি, তাদের মনন-স্মরণে গেঁথে আছে সেসব স্মৃতির রঙিন গল্প।
সেদিন গ্রাম থেকে আসার পথে মাঠে ফসলের স্তুপ, কাস্তে দিয়ে ধান কাটা আর খড়ের দড়ি (“জোনা”) দিয়ে বেঁধে মাথায় বা বাঁশের “ওইসে” দিয়ে দৌড়ে-ছন্দে ধান আনা, মাড়াই ইত্যাদিতে কৃষকের ব্যস্ততা দেখে মনে পড়ে গেলো সেই দুরন্ত বালিবেলা।
কবিগুরুর ভাষায়- ‘ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি”…!
কখনো দাদার সাথে, কখনো বাবার সাথে অগ্রহায়নে বীজতলা গুলোতে সুগন্ধি ধান (বিনি ধান, গোপালভোগ কিংবা কাটারিভোগ) কাটার সময় কাঁচির সাথে নিতাম হাত জাল। না, মাছ ধরার জন্য নয়। ”বাডই” নামের চড়ুই পাখির মত এক ধরণের পাখি সে সব সুগন্ধি ধানের মাঠে থাকতো। সে কী উত্তেজনা! উপরে জাল ফেলে ভিতরে ঢুকে আস্তে আস্তে ধান কাটা! অবশেষে একটা বা দুইটা কাঙ্ক্ষিত “বাডই” পেলে সে কী আনন্দ! বলা হত, “এক বাডই, তের মূলো””( অর্থাৎ একটা ‘বাডই’ দিয়ে তেরটা মুলা (সবজি) রান্না করলেও অমৃত স্বাদের কমতি হয়না!..
”””””””””’কৃষকের যখন “মাঠভরা ধান” তখন ধানকাটা মাঠ থেকে পরে থাকা ধানের ”ছরা” কুড়িয়ে জমানো ছিল আমাদের বালকদের আরেক সঞ্চয়! ততটা দৈনতা না থাকলেও ‘নিজের’ সঞ্চয়ের ধান দিয়ে ‘এক সের ধানে ৪/৫ টি মোয়া’ কেনার লোভ কে সামলায়?
বর্তমানের লাইনের গ্যাস তখন আমাদের গ্রামে ছিলনা; সুযোগ বুঝে জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগতো কাটা ধানের অবশিষ্ট অংশ -যা ”নাড়া” নামে পরিচিত ছিল। অনেক সময় ৬/৮ ইঞ্চি লম্বা ”নাড়া” কাটার ক্ষেত্রে এক ধরণের প্রতিযোগিতা ও দেখা যেত জ্বালানি সংকটের সেই দিনে। আবার মাঠে নাড়ার স্তুপ থেকে কিছু নাড়া ধার নিয়ে রাতে খোলা মাঠে প্যান্ডেল দিয়ে ”ফোআতি-ভাত” বা নৈশ কালীন পিকনিকে কনকনে শীত থেকে মুক্তি পেতে ফ্লোর কার্পেটের মতো ব্যবহার করতাম, এই যেন সেদিন!!
ধান কাটা বা নেয়া শেষ তো কি হয়েছে, ইঁদুর গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ যেন চোরের উপর বাটপারি! বলা হত, ”ও-ন মাসত এনধুর এ অ তেরো ও বিয়ে গড়ে” (অগ্রহায়ণ মাসে ইঁদুরও তেরটা বিয়ে করে””অর্থাৎ এই নবান্নে সারা বছরের ধান সংগ্রহে ইঁদুর ও জনবল বৃদ্ধি করে! আর বেচারা ইঁদুর গর্ত করে যে জায়গায় মাঠের ধান কেটে লুকিয়ে রাখে, বালকেরা ধান কাটার পর দৃশ্যমান সে গর্ত কোদাল দিয়ে কুড়ে ধানগুলো নিয়ে যেত; এ যেন তাদের বিরাট দুঃসাহসিক অভিযান! আজকের বালকেরা যদি সেই রোমাঞ্চ দেখতো!
ধান, নাড়া নেয়া শেষ; এবার মাঠ থেকে মাটির খন্ড (গ্রামে বলা হতো ”দলা”) সংগ্রহ যেন আরেক জৌলুস! গ্রামের মাটির ঘরের দরজার পাশে (“ডেইলে”) ছিল সারিবদ্ধ মাটির দলা! বাড়িতে চলত ভাঁপা পিটার উৎসব ..
খড়ের গাদা (কুইজ্যাঁ) যেন দৌড়-ঝাঁপ, লুকোচুরি কিংবা উপরে বসে লাফালাফি যেন ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে এক কাঙ্খিত স্পোর্টস!
খালি মাঠে এবার শুরু হয় নরম মাঠে ক্রিকেট খেলার উপযোগী করার কাজ; ক্রিকেট ক্রিজ তৈরি, উঁচু আইল কেটে সমান করা, বাদাম গাছের স্ট্যাম্প আর কাঠের ব্যাট বানানো যেন আমাদের পুরানো অভ্যাস! মাঝি পাড়া, জারুল তলা, মঙ্গল খালি বা হাজী পাড়ার সাথে কত টুর্নামেন্ট, কত উত্তেজনার ম্যাচ! যেন সেদিনের কথা!
#রাউজানের #মোহাম্মদপুর #বানু #হাজির #বাড়ির সামনের ”গান্ধী স্টেডিয়াম” নামে খ্যাত মাঠের দুরন্ত সকাল, ক্লান্তিহীন বিকেলে আর ফুটবলের “সন্ধ্যগোল” এর কথা কি মনে আছে বাড়ির সুমন, কুতুব, ইসমাইল, রফিক, ইসমাইল, মহিম, মাহাবুব (প্রয়াত), টিঙ্কু, আলী, ওসমান, সোলেমান, সেলিম, জামাল, মোজাম্মেল, জাকের, ইসহাক ভাই, সুজা ভাই, মহিউদ্দিন ভাই, শাহজাহান ভাই, কালাম চাচা, শহীদুল্লাহ ভাই, হাসমত আলী বাড়ির বাহার, ফরহাদ, কবির, খুলন পন্ডিত বাড়ির টিটু, পারভেজ (প্রয়াত), সাইফুদ্দিন, মুয়াজ্জিন বাড়ির মামুন, নিজাম, আব্বাস, নজমুল হুদা চৌ: বাড়ির হিরু ভাই, কামাল দফাদার বাড়ির এরফান, গিয়াস, সামনের হিন্দু বাড়িতে বন্ধুবর পঙ্কজ, গনেশদের কথা কিভাবে বিস্মৃত হয় বল?.
আজকের বালকেরা কি পায় এভাবে সীমানাহীন সমাজ, বৈষম্যহীন বন্ধুত্ব আর বাঁধহীন শৈশবের সেই আমেজ, সেই দুরন্তপনার আনন্দ?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ুইটার ইত্যাদির রঙিন যুগে অগণিত বন্ধুত্বের হাতছানিতেও একবারের জন্য স্মৃতি থেকে বিচ্যুত হয়না আমার সোনালী বাল্যকাল।।
কবি জীবনানন্দ দাশের সে আকুতি যেন আমারও-
‘’আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়,
হয়তো মানুষ নয় হয়তো শঙ্খচিল শালিখের বেশে..”
——-
মোঃ নাজিম উদ্দিন
nazim3852@gmail.com ০৯-১২-২০১৮