জীবনের অর্থ আপেক্ষিকঃ অনুভূতিও-
#শিরোনামহীন গদ্য!
গ্রামের ছোট নদীতে জাল দিয়ে মাছধরার দৃশ্য প্রতিদিনকার হলেও কিছু দর্শকের জটলা দেখবেন, অতি আগ্রহে শত জিজ্ঞাসা, কত উপদেশ! পাশে বয়ে চলা ছোট নদী, পাড়ে জন্মানো গুল্ম, বনফুল কিংবা “অমরগাছের” ফুল ছোট বাচ্চাদের কাছে আকর্ষণীয় হলেও যব-বৃদ্ধার কাছে যেন নিত্যদৃশ্য।
পাশের ধানক্ষেতে নতুন বীজতলায় কাকতাড়ুয়ার দৃশ্য, কিছু দূরে শতশত সাদাবক উড়ার দৃশ্য, সবুজাভ ধানের চারার ছোট চুলে আঁচড়ে দেয়ার দৃশ্য, বিকাল হতে হতে গোধুলির শান্ত মাঠে অপেশাদার রাখাল অশান্ত গো-ছানা ঘরে নেয়ার রশিটানার দৃশ্য, পাশের আমনকাটার পরের উচু-নিচু মাঠে কষ্টে সমান করা ক্রিকেট ক্রিজে ছক্কা মারার দৃশ্য, কিংবা অমিমাংসিত ফুটবল ম্যাচে সন্ধ্যা-গোলের অপেক্ষায় দর্শকের ইকুতির গ্রাম্য দৃশ্য আপনাকে ততটা না টানলেও যখন প্রকৃতিপ্রেমী ফটোগ্রাফার খুব আগ্রহ, খুব উৎসাহে লক্ষাধিক টাকা দামের ডি,এস,এল,আর ক্যামেরায় ছবি তোলে সহস্র; বিস্মিত চোখ কপালে ওঠাবেন না। যে রবের সৃষ্ট প্রকৃতিতে unity in diversity, যে সৃষ্টিকর্তা কোন পিলার ছাড়া বড় আসমান শুন্যে দাড় করিয়েছেন, কোন রিমোট ছাড়া জোয়ার-ভাটার সুশৃঙ্খল রুটিনে পানির যে গতিময়তা, সেসব দৃশ্য গ্রামবাসীর জন্য তাচ্ছিল্যেে হতে পারে, কিন্তু সে ফটোগ্রাফার হয়ত স্বনিয়ন্ত্রত প্রকৃতিতে “existence of Creator” খুঁজে পাচ্ছেন, খুঁজে পান wow না বলে সুবহানআল্লাহ বলার শত উপকরণ, জীবনের অর্থ খুঁজে ফিরে পান সে প্রকৃতিতে, সে tranquillity তে, সেটা কি জানেন?
খুব ঠান্ডায় আশিবছরের অশীতিপর বৃদ্ধ কনকনে শীতে দুবাই থেকে ছেলের পাঠানো আরামের কম্বলের বিছানা ছেড়ে ছোবহে সাদেকের সময় ঘড়ির এলার্ম ছাড়াই জেগে উঠে পৌঁছেন মোয়াজ্জিন আসার আগেই, সবার আগে আজান দিয়ে “ঘুম থেকে নামাজ উত্তম” আরবিতে ডেকে সুন্নত পড়ে বেড়ার গাঁয়ের কাঁচা মসজিদের ফাঁক দিয়ে আসা শীতের স্রোত উপেক্ষা করে নিরবে, নিশ্চুপ সে মাওলার নাম জপে সে তৃপ্তি পায়, নিজের পাপরাজি ক্ষমা চেয়ে, নিজের অতিক্ষুদ্রকায় অস্তিত্বকে মহান রবের সৃষ্ট পরবর্তী অনন্ত-দুনিয়ার কথা ভেবে নিঃশব্দ কান্নায় অশ্রুময় করে রাখে মাটির মেজেতে সাঁটানো মাদুর বা পুরানো জায়নামাজটি, সে অনুভূতি কি জীবন নয়? আমরা কি কখনো সে অনুভুতি পেয়েছি?
বাড়ির কারো কষ্ট-সংকট? কিছু তরুণকে দেখবেন, খবর পেয়ে নিজ উদ্যোগে দৌড় দেয়; কারো মৃত্যুর খবরে দৌড় দেয় কবর-তৈরি, গোসল করার কাজে, এক দৌড়ে সবাইকে জানানো, জানাজা-দাফনসহ সব কাজে নিজের সব-ব্যস্ততা পেলে ছুটে চলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে! কারো কোন অনুষ্টান, কোন সামাজিক কাজ, রাস্তা ভরাট, কবরস্থান পরিষ্কার, মসজিদ উন্নয়নে টাকা উত্তোলন, অসহায় কন্যাদায়গ্রস্থ বিধবার কন্যার বিয়ের জন্য নিজে দ্বারে দ্বারে গিয়ে অর্থ-অনুদান সংগ্রহ করে কোন ইতস্ততা ছাড়াই- বৈষয়িক ক্যারিয়ারে কর্পোরেট জীবনে স্যুট-টাই পড়া কিছু তরুণের মত posh জনদের কাছে নাক সিটকানো কাজ হলেও
“পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি,
এ জীবন মন সকলি দাও
তার মত সুখ কোথাও কি আছো
আপনার কথা ভুলিয়া যাও”।
কিংবা
আপনার লয়ে বিব্রত রহিতে
আসেনাই কেহ অবনি পরে
সকলের তরে সকলে মোরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে
অথবা
“He prayeth well, who loveth well
Both man and bird and beast.
He prayeth best, who loveth best
All things both great and small;
For the dear God who loveth us,
He made and loveth all.”
– মন্ত্রে দীক্ষিত, তাদের অনুভব-অনুভুতি কী স্বর্গীয় তা যদি সবাই জানতো? তাদের কাছে জীবন মানে বৈষয়িক উন্নতি বা বাড়ি-গাড়ি-বিলাস নয়, তারা বিন্দুমাত্র পরার্থ সিন্ধুর পরিতৃপ্তির ঢেকুর।
গত সপ্তাহে গ্রামের অস্বচ্ছল চা-বিক্রতার অসুস্থ ছেলের এপেন্ডিসাইটিসের ব্যথায় অপারেশন জরুরী হয়ে পড়ায় বাড়ির ৩/৪ জন তরুণ অর্থ সংগ্রহ করে শহরের ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে অপারেশন সফল-সম্পন্ন করার ঘটনা দূরে চা-বিক্রি করতে যাওয়া বাবা ঘরে এসেই জানতে পারে! সম্বলহীন দুঃখীনী মায়ের অবলম্বন হয়ে রাতজেগে পাশে ছিল সেসব মহৎ তরদদধণ! তাদের কাছে জীবন রুটিনে বাঁধা দিনাতিপাত নয়: জীবন মানে ঘটে যাওয়া প্রবাহে সুখে দুঃখে মানুষের পাশে দাড়ানো।
গ্রামের একজন হাফেজ নিজ পারিবারিক উদ্যোগে একটা হেফজখানা চালায়: ভাবী হাফেজদের দেয়া যৎসামান্য মাসিক ভাতা দিয়ে কোনরকমে চালায়, কিন্ত প্রচারসর্বস্ব হওয়ার আশংকায় প্রাতিষ্ঠানিক অনুদানে অস্বীকৃতি জানান কোরআন শিখে অন্যজনকে শিখানোর উত্তম কাজে নিয়োজিত হাফেজ আবদুর করিম।
জীবনের এক পর্যায়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও নিজের অনুসারীকে dictation দিয়ে সম্পন্ন করেন ইতিহাসবিখ্যাত পুস্তক “মসনবী শরীফ”: আল্লামা জালালুদ্দিন রুমী (রঃ) নিজের লব্ধ জ্ঞানালোক চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়ার যে অনাবিল প্রশান্তি, পরিতৃপ্তি পেয়েছেন, পেয়েছেন জীবনোপলব্ধির স্বাদ, তাতে অমর হয়ে আছেন এ মনীষী। ইংরেজ কবি John Milton ও দৃষ্টিশক্তি হারানোর অজুহ্ত না দিয়ে অতি কষ্টে অন্যের সহায়তায় সম্পন্ন করেছেন বহু খন্ডে বিভক্ত মহাকাব্য Paradise Lost আর, Paradise Retained. ইবনে সিনার ঔষধ উদ্ভাবন, এডিসনের বৈদ্যুতিক বাতি উদ্ভাবন, জন লজি বেয়ার্ডের টেলিভিশন উদ্ভাবন, কিংবা চার্লস ব্যাবেজের কম্পিউটার উদ্ভাবন, নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্র উদ্ভাবন, শারিরীক প্রতিবন্ধী ষ্টিফেন হকিংয়ের অবদান জীবনের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিবে যথার্থই। মাদার তেরেসা, রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল বা শরৎচন্দ্র-বঙ্কিমচন্দ্রগণ শুধু জীবন কী, কিসে জীবনের মাহাত্ম্য – তা দেখিয়ে দিয়েছেন তাদের কর্মমাঝে!
হযরত ইউসুফ (আঃ), হযরত মুসা (আঃ), হযরত ইব্রাহীম (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) এবং সর্বোপরী মহানবী সর্বশ্রেষ্ট মহামানব হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহর প্রেমে “রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, ওয়া রাদুয়ান” হয়ে হিজবুল্লাহ (আল্লাহর দল) ভুক্ত হয়ে তাওয়াক্কুল শিখিয়েছেন, শিখিয়েছেন কিভাবে জীবন-মরণ সফে দিতে হয় সেই প্রভুর ইচ্ছার কাছে।
লাইলির প্রেমে পাগল প্রেমিক (ডাকরাম মজনু) বুঝিয়েছেন প্রেমের স্বরূপ; কিংবা শিরি ফরহাদগণ করেছেন প্রেমাষ্পদের প্রতি গভীর প্রেমের ইতিহাস।
জীবন-অনুভব-অনুভূতি সবসময় আপেক্ষিক! সময়ে সময় তা প্রেক্ষাপটে ভিন্নতর হয় জীবনের উদ্দেশ্য-আকাঙ্খা! জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে একবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্টাতা অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ প্রতি উত্তরে বলেন, একটা সময় ছিল যখন একটি কামরাঙার জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারতাম; আরেকটা বয়স ছিল যখন প্রিয়ার কালো তিলের জন্য জীবন বিকিয়ে দিতে পারতাম হাসতে হাসতে: আর এখন, জীবনের অর্থ অন্যরকম!
জীবন কি? তার অর্থ যেমন গভীর, জীবনের উদ্দেশ্য, সার্থকতাও আপেক্ষিক- ভিন্নতর! জীবনের সংক্ষিপ্ত এ আয়ুষ্কাল, নাট্যকার সেক্সপিয়ারের ভায়ায় -a walking shadow- তা কখন-কীভাবে-কি কাজে ব্যয় করবেন, তা নিজেই ভাল ভাবে অনুধাবন করতে হয়…
—–
মোঃ নাজিম উদ্দিন