অধ্যাপক মৃদুল চক্রবর্তী স্যারঃ এক আলোকিত শিক্ষাগুরুর স্মরণ

Sep 10, 2022 | আত্মউন্নয়ন ও মোটিভেশন, ধর্ম, জীবন এবং জীবনভাবনা

রাউজান কলেজের অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় মৃদুল চক্রবর্তী স্যারঃ এক আলোকিত শিক্ষাগুরুর স্মরণ

অধ্যাপক মৃদুল চক্রবর্তী। রাউজান উপজেলার ঐতিহ্যবাহী রাউজান সরকারি কলেজের শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু, অর্থনীতি বিভাগের  সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। সাদা বা প্রায়শই এক কালারের শার্ট বা গেঞ্জি পরিধান করা দীর্ঘকায় লিকলিকে শরীরে, মাথা সামান্য নেড়ে নেড়েই প্রবেশ করতেন ক্লাসে। মুখ দেখে বুঝা যেতো মাত্রই পান খাওয়া শেষ করলেন!
কলেজের মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থিরা একসাথেই অর্থনীতির ক্লাস করতাম।
শিক্ষার্থীদের প্রিয় শিক্ষক এবং সাদাসিদে জীবনের প্রতিকৃতি নির্মোহ, আলোকিত শিক্ষকের নাম মৃদুল স্যার।

১৯৯৭ সালে রাউজান কলেজে ভর্তি হই। এসএসসির বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে অর্থনীতি একেবারে নতুন বিষয় ছিলো। অধ্যাপক মৃদুল চক্রবর্তী স্যার এবং অধ্যাপক আবদুর রশিদ চৌধুরী স্যার ছিলেন এ বিভাগের আমাদের দুই শিক্ষক। সংক্ষেপে একজন MC আরেকজন ARC।

প্রথম দিকের ক্লাসে ছিলো অর্থনীতির সংজ্ঞার আলোচনা। মৃদুল স্যারে পঠিত ব্যাখ্যার এখনো কিছু স্মরণ করতে পারি (স্মৃতির প্রতারণা ও ভুল ধরিয়ে শুদ্ধটা জানানোর জন্য অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষার্থীদের বিনীত অনুরোধ)। অধ্যাপক এল, রবিনসের সংজ্ঞা ছিলো ‘অর্থনীতি মানুষের অসীম অভাব ও সীমিত সম্পদ ও বিকল্প ব্যবহারের সমন্বয় নিয়ে আলোচনা করে’.। এরপর প্রতিটি পয়েন্ট এতো সুন্দরভাবে বু্ঝাতেন, সব যেন মাথায় স্তরে স্তরে সুবিন্যস্ত থাকতো।

‘মনে করো এই ক্লাস রুমটা আমাদের দেশ। তোমরা হলে জনগণ।…’ এভাবে শুরু করতেন উপমা, রূপক ব্যবহার করে বুঝানো। যেমন, চাহিদা কি? প্রশ্নটা শুনেই কত সহজ ভেবে ছাত্ররা উত্তর দিতো- চাহিদা হলো কিছু পাওয়ার ইচ্ছা বা আকাঙ্খা। পরে সবাই জানলাম, চাহিদা হতেও কমপক্ষে তিনটা শর্ত লাগে: ইচ্ছা, সামর্থ্য এবং সামর্থ্য ব্যয় করে কেনার বা গ্রহণের আগ্রহ!
একে একে জানলাম, Elasticity of demand, চাহিদার স্থিতিস্থাপকতা,  Demand Curve, Supply Curve, এসব রেখার নিম্নগামী বা উর্ধ্বগামী রূপ, ম্যালথাসের জনসংখ্য তথ্য ইত্যাদি।

নিজস্ব পঠন শৈলী, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, মনযোগ আকর্ষণকারী উপস্থাপন, শব্দপ্রয়োগে নতুনত্ব, ইত্যাদি সহজেই আলাদা করে দিতো  অধ্যাপক মৃদুল স্যারকে।

আন্তরিকতা, সারল্যের চাদরে গভীর জ্ঞানের আচ্ছাদনের এক মোহনীয় ভঙ্গি ছিলো স্যারের। কোন শিক্ষার্থির কোন প্রশ্নবানে হতেন না বিরক্ত।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য, বাচনভঙ্গি,  গুরুগাম্ভির্য, জবাবদিহিতা ও আন্তরিকতার এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে বছর আমাদের মন-মননে আলাদা স্থান দখল করলেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মৃদুল স্যার। সারের সময়নিষ্ঠা ছিলো অসাধারণ।

অর্থনীতির অন্য শিক্ষক অধ্যাপক রশিদ স্যারের রম্যরসের কারণে যখন অনেকে ‘রসিক’ স্যার হিনেবে জানতেন, সেখানে মৃদুল স্যার ছিলেন খুব কড়া শাসনের, চোখ লাল করে শাসন করার মানুষ।
তবে এ কাঠিন্যের আড়ালে থাকতো কোমল হৃদয়; সব উজার করে দিয়ে মানুষের জন্য কিছু করার বাসনা, তাগিদ ও অভ্যাস। নিজের এলাকায় পাঠাগার গড়ে বা বই দান করে, নিজের উপার্জিত অর্থ প্রায়শই দুঃস্থদের মাঝে দান করে জ্ঞানের আলোকপ্রদীপ নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্বালানোর প্রচেষ্টা ছিলো আমরণ। নির্মোহ, নির্লোভ মৃদুল স্যার যেন বিশ্বাস করতেন, “নিজের খাবার
বিলিয়ে দিবো অনাহারীর মুখে..” বার্তাগুলো।
কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে মাঝে মধ্যে কলেজে গেলে স্যারের সাথে দেখা হতো। কথা হতো। ধীরে ধীরে বয়োবৃদ্ধ হলেন। বেশ কবছর আগেই এক বন্ধুর কাছে জানলাম, স্যার আর নেই। প্রচারবিমুখ মৃদুল স্যার চলে গেলেন নিরবে, সবার অলক্ষ্যে।

মৃদুল স্যার আমার, আমাদের, শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে চির জাগরুক থাকবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।

আজ আমরা সবাই যে যার পেশাগত, সাংসারিক কর্মব্যস্ততায় সে প্রিয় মৃদুল স্যারের পরিবারের খোঁজ নেয়ার ফুসরত পাই না কখনো। মূল পড়াশুনার ভিত্তি তৈরি করে দেয়া মৃদুল  স্যারেরা হয়তো মরণোত্তর সম্মাননা পাবেন না,
কিন্তু আমরা দীক্ষালাভে ধন্য শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন প্রিয় অধ্যাপক মৃদুল চক্রবর্তী স্যার।।

স্মরণীয় হয়ে হৃদয়ের মাঝে বেঁচে থাকবেন অধ্যাপক আহমদ হোসেন স্যার, বীরেন স্যার, রঞ্জিত কুমার রুদ্র, আবদুর রশিদ স্যার, সুকুমার স্যার, সাইফুল স্যার, মোনাব্বের স্যার, খালেদ বিন চৌধুরী স্যার, সরোজ স্যার, আনন্দ মোহন স্যার, চিন্তাহরণ স্যার, দিদার স্যার, মনোয়ারা ম্যাডাম, সেলিম নেওয়াজ চৌধুরী স্যার, ইসলাম স্যারেরা।

স্যারের আত্মার শান্তি কামনা করি।

*******
মোঃ নাজিম উদ্দিন
(স্যারের ছাত্র)
উচ্চ মাধ্যমিক (বাণিজ্য)-
১৯৯৭-৯৮ ব্যাচ
রাউজান সরকারী কলেজ। চট্টগ্রাম।

রচনাকাল ঃ সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২

লেখাটি লিখেছেন