শৈশব-কৈশোরের রমজানঃ কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

Apr 3, 2023 | ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-রাজনীতি

View : 141
 

শৈশব-কৈশোরের রমজানঃ কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

আমাদের ছোটবেলার রমজান স্মৃতি বেশ বর্ণিল, ঘটনাবহুল। কয়েকটি স্মৃতির জাবর কাটা হোক!

প্রথমে সেহেরি। চট্টগ্রামের ভাষায় “ফোঁয়াইত্তে”.। সেহেরিতে মাইকে ডাকা হতো। ”সেহেরি হাইবের সময় অইয়্যি, অনরা উডি যঅন গুই। এহন রাইত চাইরটা। সেহেরি হাইবের শেষ সময় রাত চাইরটা ১৫ মিনিট।” এভাবে ১৫/২০ মিনিট ডাকা হতো মাইকে। তাছাড়া, উর্দু ভাষায় নাতে মোস্তফাও চলতো মাইকে। সেহেরি খেয়ে মসজিদে ছুটতাম সকলে। নামাজ শেষে আর ঘুম নেই। ঘুরাঘুরি।
রমজানে মক্তবে পড়তে যেতাম দুপুরে, সারামাস যেহেতু স্কুল বন্ধ। প্রতিদিন একপারা করে রমজানে সম্পূর্ণ কোরআন পড়া হতো তখন।

খুব ছোটবেলায় বড়রা দুষ্টুমি করে বলতো, কলা গাছে কামড় দিয়ে রোজা জমা দিয়ে এসো: তারপর পুকুরে নেমে পানি খেয়ে নিও। খাওয়া শেষে কলাগাছে আবার কামড় দিয়ে রোজা ফেরত নিয়ে এসো- এসব কথা অনেক শিশু-কিশোর সত্যি ভেবে নিতো: আর ঘটনার পর সে শিশু কিশোরকে নিয়ে সে কী আনন্দ! রোজায় পিপাসার কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য অনেকক্ষণ পুকুরে গোসলে থাকতো অনেক কিশোর। পিপাসার কারণে আছরের পর ইফতারে মাত্র এক ঘন্টা আগেও রোজা ভেঙ্গেছি- এমন রেকর্ডও আছে!.

কয়টা রোজা রেখেছে, এ নিয়ে হতো বাহাস, সাথে থাকতো সেহরিতে তোলার বায়না। বয়স যখন ৭/৮/৯, তখন ত্রিশ রোজা থাকতে পারতামনা বলে শুধু শুক্রবার, বা বৃহস্পতিবার, সাথে শবে কদরের দিনগুলোতে রোজা রাখার জন্য সেহেরিতে তোলা হতো: বড়রা বলতেন, এসব দিনে রোজায় সওয়াব বেশি।

সারাদিন এসব করেও সময় ফুরাতোনা। তখন কেউ লুডু, কেউ কেরাম ইত্যাদি খেলতো। মাঠে চলতো ফঅর খেলা (দাড়িয়াবান্ধা খেলা).. মেয়েরা শীতলপাটি বানানো, ছুট্টি বা হাতের নাস্তা বানানোতে সময় কাটাতো। আজকের সমাজের দৃশ্যের মতো তখন বাহারি পদের ইফতারি বানাতে সারাদিন সময় লাগতো না বৈকি!

ইফতারের আগে মুহুর্তে পাশের বাড়ির টিউবওয়েল থেকে খাবার পানি আনতে যেতাম দল বেঁধে। তখন ফ্রিজের আকাল। বাজারে বরফ কেটে বিক্রি করা হতো! ইফতারি বলতে সর্বোচ্চ চনাবুট/ ছোলা, পেয়াজু, মুড়ি, লেবুর বা দইয়ের শরবত। কিছু ক্ষেত্রে বেগুনি ও বাংলা সেমাই। মাঝে মধ্যে নুডলসও.. তখন অভাব অনটনের গ্রামীণ সমাজে গুটিকয়েক বিত্তবান ছাড়া প্রায় সকলেই শরবতের পর সামান্য মুড়ি-ছোলা আর তার পরপরই ভাত খেয়ে নিতো। মসজিদে বা কোথাও ইফতার পার্টি বা মাহফিল হলে সেখানে ভীড় হতো।
মাঝে মাঝে বাড়ির কাছে বা দূরের আত্মীয়দের ঘরে তৈরি ইফতারি নিয়ে যেতে হতো: শৈশবে সে ইফতারি থেকে নিজেরা কিছু খেয়েও ফেলেছি কতবার! মসজিদে নামাজের পর একসাথে ইমাম ও মুসল্লিদের সাথে ইফতার করার উদাহরণও কম নয়। বিভিন্ন ঘর থেকে বাহারি ইফতারি ইমাম মোয়াজ্জিন দের জন্য পাঠানো হতো বাদ আসর থেকেই।
তখন খুব কম মসজিদেই মাইকে আজান দেয়া হতো: মাঝে মাঝে সাইরান দেয়া হতো! আজান দেয়ার সাথে সাথে পিনপতন নিরবতা।

শনি ও বুধবার গ্রামের বাজারে হাটবার। সেদিনগুলোতে তিনরাস্তার মোড়ে কলসিতে করে খাওয়ার পানি রাখতেন সচেতন গ্রামবাসী, যাতে পথচারীরা পানি খেয়ে রোজা ভাঙতে পারেন।

রাতে তারাবিহ। রমজান আলী হাটে খতম তারাবিহ হতো। যেতাম। পরে সমাজের বা বাড়ির মসজিদেও খতম তারাবিহ হতো। খতম তারাবির সময় ইমাম সাহেব রুকুতে না যাওয়া পর্যন্ত চলতো ছুটোছুটি। যেদিন যে মসজিদে কোন প্রতিবেশি নাস্তা দিবে বলে খবর পেতাম, সেদিন সব বালক সে মসজিদে ভীড়!
সাধারণত, সাতাইশ রমজান বা শবে কদর রাতে মসজিদে টাকা তোলা হতো। বিকালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসা তো সমাজের যুবকেরা। সেদিন মসজিদে জিলাপি, বন বা মিষ্টি ইত্যাদি নাস্তা দেয়া হতো। তাছাড়া, টাকা তোলার সময় এক আনন্দময় পরিবেশের সৃষ্টি হতো। কেউ দিচ্ছে ৫ টাকা, কেউ ১০, ২০ বা ১০০ টাকা। শুধু কয়েকজন ধনাঢ্য মুসল্লী ৫০০ টাকা বা ১০০০ টাকা দিতেন৷ শিশুরাও টাকার ওজন বুঝতো! ৫ টাকা হলে “মারহাবা” আওয়াজটা ছোট হতো আর ৫০০ বা ১০০০ টাকা হলে ‘মারহাবা ‘ আওয়াজ ব হতো! মোট কয়টাকা হলো, কোন হাফেজ, কোন ইমাম কত টাকা করে পেলেন, এসব ছিলো সকলের আগ্রহের বিষয়৷ তবে যেসব মসজিদে সুরা তারাবি হতো, সেখানে টাকা উঠতো খুব কম: সব মিলে দুই বা তিন হাজার!

মসজিদে শেষ দশদিন এতেক্বাফকারী মুসল্লীর সম্মান ছিলো ছোটবড় সবার কাছে। চাঁদ দেখা গেলে ”নারায়ে তাকবীর” ধ্বনিতে মিছিল সহকারে এতেক্বাফকারীকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়া হতো।
রোজা ২৯ হবে না ত্রিশে, এ নিয়ে কত আগ্রহ! ছোটদের ইচ্ছে হলো, একটা রোজা না থাকলেই যেন বাঁচে! চাঁদ দেখতে মাগরিবের পরপর রাস্তাঢ চলে যেতো বেশিরভাগ শিশু-কিশোর। চাঁদ দেখা গেলে একটা কমন ছন্দে একে অপরকে খেপাতো: ”আজিয়ে রোজা হালিয়ে ঈদ, তোর মা কাঁদে ফিত ফিত”- বাড়ি ফিরলে বিটিভিতে (যদিও সারা বাড়িতে একজন বা দুজনের ঘরেই শুধু টিভি থাকতো) বাজতো- ‘ও মন রমজানে ঔ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ৷ “”

এভাবে পার হতো ছোটবেলার রমজান মাস। আহা সে শৈশব, আহা স্মৃতি!

গ্রামের স্মৃতি। অনুন্নত সমাজ। ছিলো অভাব। ছিলো সংকট। সর্বত্র বেশ অনুন্নত ব্যবস্থা। কিন্তু ছিলো প্রাণপ্রাচুর্য। প্রাণচাঞ্চল্য। জীবন। জীবনীশক্তি।


মোঃ নাজিম উদ্দিন
এপ্রিল ৩, ২০২৩