যে ভাবনা কখনো ভাবি না

———————

চোখের সামনের দেখা বিষয়ে আমাদের বিচারিক দক্ষতা বিচিত্র। অনেকটি বইয়ের নাম দেখে বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা করার মতো। সেজন্য George Eliot সেই ১৯৪০ এর দশকে বলেছেন, ‘Do not judge a book by its cover’.

ধর্মে সিদ্ধিলাভ, বৈষয়িক সাফল্য, আধ্যাত্মিকতার উৎকর্ষতা ইত্যাদি দেখে অনেকে সহজেই বলে ফেলে – কী চরম সাফল্য! ‘ আহা, তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে এসেছেন’!

কিন্তু আসলেই কি তাই? প্রতি যুগে হাতে গোনা ক’জন ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগই ‘কষ্ট করেই কেষ্ট’ পেয়েছেন; ‘সময় থাকতে সাধন’ করেছেন।
বিল গেটস বা ওয়ারেন বাফেট কিংবা বিরলা, টাটাগ্রুপের প্রধানগণের ঐশ্বর্য, বৈভব, প্রভাব, প্রতিপত্তি দেখে যদি ভাবেন, আহা! কত সহজেই বিশ্বের শ্রেষ্ট বা নামকরা ধনীর তালিকায় পৌঁছেছেন তাঁরা (!), তাহলে মশাই আপনি ভুলের রাজ্যে আছেন। তাদের রঙিন বর্তমানচিত্র দেখে হয়তো পেছনের সাদাকালো গল্পের কেঁচো বের করতে চাইলে বের হবে বিনিদ্র রজনীর অবর্ণনীয় সাধনার বড় সাপ!

বড় শিল্পপতির রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম, সাফল্যের কীর্তিগাঁথা, সাধকের অভাবনীয় উচ্চতা ইত্যাদি দেখে যারা ভ্রু মাথায় তুলেন, তারা তাদের সর অতীত জানেনা, যখন ইটকে বালিশ, আকাশকে ছাদ, শুধু পানিকেই একনাগাড়ে বহুবেলার একমাত্র খাবার বানিয়ে টিকে ছিলেন দুঃসহ সে অধ্যায়গুলোতে।

বহু ভাষায় পন্ডিত ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, হরিরাথ দে কিংবা সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষাজ্ঞান দেখে অজ্ঞান হবার আগে কি ভেবে দেখেছেন, কত শখ, কত সাধকে পায়ে পিষ্ট করে একে একে একাধিক (ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ক্ষেত্রে ৩৬ এর অধিক) ভাষার উপর দখল, দক্ষতা অর্জন করেছেন এসব বহুভাষাবিদ!

মাত্র ৯০ মিনিট ফুটবল খেলায় পায়ের যে নৈপুণ্যে মাঠ মাতিয়ে ক্রীড়াপ্রেমীদের মনের মণিকোটায় স্থান নিয়েছেন পেলে, মেরেডোনা, মেসি, রোনালদোগণ, সে নৈপুণ্য অর্জনে অনুশীলন মাঠে, নেটে কত শত দিন, কত শত রাত পরিশ্রম ও সাধনা করতে হয়েছে- সে খবর সে দু’পা এবং তাদের বাহক খেলোয়ারেরাই শুধু জানেন।

একাডেমিক বিষয়েও দেখা যেতো, ক্লাসে তখন (এখন শুধু জিপিএতেই সাবাড়!) ‘ফার্স্ট বয় বা ফার্স্ট গার্ল’ দের প্রতি বেক বেঞ্চার শিক্ষার্থিদের পিতামাতার আড়চোখ ছিলো বরাবরই; ফার্স্ট বা ফ্রন্ট বেঞ্চারদের পিতামাতা ‘মুখ’ বা নজর পড়া থেকে বাঁচাতে কত কথা, ছোটবেলায় কপালে কালো টিপ্পনী দিতেন, তার ইয়ত্ত্বা আছে? কিন্তু এ অবস্থানে যেতে ‘ফার্স্ট’দের কত কাটঘর পোড়াতে হয়েছে্র বাদ দিতে হয়েছে কত বৈকালিক আনন্দ, কত অনুষ্টান- তা শুধু ফার্স্ট বেঞ্চারেরাই জানে: তাদের জন্মগত মেধাবী ভেবে যারা ‘হিংসা’ করেন, তারা তাদের ‘জন্মপরবর্তী সাধনা ও পরিশ্রম কি ভেবে দেখেন?

এভারেস্ট চূড়া, কেওকারাডং, জাদিপায় ঝর্ণা, অমিয়কুম ঝর্ণা, রেমাক্রী জলপ্রপাত, নাফাকুম ঝর্ণা, রেমাক্রী জলপ্রপাত, বড়পাথর, তিনাফ ঝর্ণা, রিজুক ঝর্ণা, বগালেক, জাদিপাই ঝর্ণা, শৈলপ্রপাত ঝর্ণা, রুপালী ঝর্ণা, আলীকদম উপজেলার দামতুয়া ঝর্ণা, করুকপাড়া ঝর্ণা, দেবতাকুমসহ অনিন্দ্য সুন্দর, নান্দনিক দর্শনীয় স্থানের চূড়ায় কারো ছবি দেখলে আমরা কত না আনন্দিত হই: ভাবি, আহা, তারা কত ভাগ্যবান! কিন্তু এরূপ স্পটে পৌঁছাতে কত রক্ত ঝরে, কত কষ্ট-ব্যথা, কত পাতা-পাতালি খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে- তার হিসাব কি কেউ রাখি?

যারা অন্যের অবস্থান দেখে মনে হয় কত উঁচুতে তারা উঠেছে, তারা ভুলে যায় কত নিচু থেকে হামাগুড়ি দিতে হয়েছে তাদের।

এ ভাবনার সমাপ্তি নেই।

—–
মোঃ নাজিম উদ্দিন
মে ২৭, ২০২১

লেখাটি লিখেছেন