মৃত্যু্বার্ষিকীতে সশ্রদ্ধ স্মরণঃ
অধ্যাপক আবদুল জলিল মুহাম্মদ মহিউল ইসলাম (রঃ)
—
ব্রিটিশ আমল থেকে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত যে’কজন জ্ঞানতাপস ব্যক্তিত্ব আমাদের গ্রাম, আমাদের রাউজানকে আলোকিত করেছেন, তাঁদের শিক্ষা, জ্ঞান, মানবসেবা, আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা এবং সর্বোপরী শিক্ষানুরাগ দিয়ে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন অধ্যাপক আবদুল জলিল মুহাম্মদ মহিউল ইসলাম (রঃ)।
১৯০০ সালের শুরুর দিকে রাউজানের মোহাম্মদপুর গ্রামের আমাদের বানু হাজির বাড়ির সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া অধ্যাপক আবদুল জলিল মুহাম্মদ মহিউল ইসলাম (পরবর্তীতে ‘জলিল শাহ’ নামে সমধিক পরিচিত) আলোকিত করেন গ্রামকে, রাুজান উপজেলাকেও।
১৯৮৫ সালের ১১ আগষ্ট তিনি ইন্তেকাল করেন। তখন আমি গ্রামে সবেমাত্র দুরন্ত শৈশব পার করছি। এ আলোকিত সাধকপুরুষের সাথে আমার এ ক্ষুদ্র জীবনে রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্পর্শ, স্মৃতি, শিক্ষা ও স্মরণীয় ঘটনা। পরবর্তীতে জীবন যাত্রায়, অভিজ্ঞতায় ধীরে ধীরে জানতে পারি আরো কিছু প্রেরণামূলক ঘটনা, উৎসাহব্যঞ্জক বিষয় যা প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে আমাদের মাঝে আলো ছড়াবে বহুদিন।
‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণালি ইতিহাসের সাথে আমাদের মোহাম্মদপুর গ্রামের এবং স্কুলের সেতুবন্ধন স্থাপনের সম্ভবত প্রথম ঘটনার ননায়ক তিনিই। ১৯২১ সালে স্থাপিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজকীয় বিভাগখ্যাত ইংরেজি বিভাগের প্রথম ব্যাচের একজন কৃতী ছাত্র হিসেবে ইতিহাসে প্রোজ্জ্বল হয়ে আছেন রত্নপ্রসবিনী মোহাম্মদপুরের কৃতী সন্তান, শিক্ষাবিদ, রাউজান কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক, আধ্যাত্মিক সাধকপুরুষ, অধ্যাপক আবদুল জলিল মুহাম্মদ মহিউল ইসলাম।
আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ পূর্বে আমার গ্রামের একজন কৃতী পুরুষ সুদূর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছেন- যা ভাবতেই শিহরিত হই, প্রাণিত হই প্রেরণার বন্যায়।
ব্রিটিশ শাসনামলে হাতে গোনা কিছু স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর যুগে লোভনীয় ক্যারিয়ারের হাতছানি, সম্ভাবনাময় জীবিকার সুযোগ থাকলেও শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন মোহাম্মদপুর জুনিয়র হাই স্কুল (বর্তমান মোহাম্মদপুর স্কুল এন্ড কলেজ)।
১৯৬৩ সালে প্রতিষ্টিত হওয়া রাউজানের তৎকালীন অন্যতম প্রধান উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্টান রাউজান কলেজে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেন বহুদিন। তৎকালীন পশ্চাদপদ গ্রামীণ জনপদে রাউজানে শিক্ষা উন্নয়নে জাতি গড়ার এ কারিগরের ভূমিকা যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
শিক্ষকতার পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়ে মনোযোগী হন তিনি। ইসলাম ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের গভীর বিষয়ে সাধনা চলতে লাগলো। বেশ কয়েকবছর দেশান্তরি ছিলেন তিনি। সেসময় ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কিছু দেশ সফর করেন বলেও জানা যায়। হয়তো সে ভ্রমণ এবং পরবর্তী সাধনায়ই মহান রবের বিশাল সৃষ্টির সাথে ক্ষুদ্র সৃষ্টির যে সম্পর্ক, তার রহস্যজ্ঞান উন্মোচনে ব্যাপৃত ছিলেন তাঁর সময়-ধ্যান-জ্ঞান।
তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা সচেতনভাবে পরিহার করে প্রমিত ভাষাতেই কথা বলতেন। রমজান আলী হাটে তাঁর যাওয়া আসার সময় সকলে তাঁকে সালাম দিতেন। তিনি পরিমিত কথা বলতেন।
কথাবার্তা, চালচলনে সাহিত্যের Literary Terms এর ব্যাপকতা যেন লক্ষণীয় ছিলো। তাঁর কথায় ছিলো রূপক, উপমা, বিরোধালঙ্কার, শ্লেষ ইত্যাদির দারুন এবং যথাযথ ব্যবহার।
আমার দাদী মরহুম ছফুরা খাতুনের সাথে জলিল দাদার ছিলো বড়ভাই-ছোটবোনের মতোই সম্পর্ক। সে সুবাদে আমার দাদা মরহুম আহমদুর রহমান এবং বাবা মরহুম।আজিমুল হকের সুযোগ হয়েছিল তাঁর দোয়া ও ভালোবাসা লাভের। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের পরিবারের প্রায় সকলের জন্মের পর নামকরণসহ প্রায় প্রতিটি সিদ্ধান্তে দাদা জলিল শাহের সক্রিয় সহায়তা ও ভূমিকা ছিলো। ছিলো দোয়া ও আন্তরিকতা, মুহাব্বতের স্রোতধারাও।
তিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি দ্বারা গ্রামের এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের অসংখ্য উপকার করেছেন। বিলিয়েছেন জ্ঞানের আলো। পরামর্শ দিয়েছেন, বিভিন্ন বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছেন তাঁর ‘বৈঠকখানায়’ কাছে আসা মানুষদের।
১৯৮৫ সালের ১১ আগষ্ট এ ক্ষণজন্মা সাধক পুরুষ ইন্তেকাল করেন। খুব শৈশবের ঘটনা হলেও তাঁর মৃতদেহ বহনের খাটিয়া অনেক উৎসুক স্বজনের ধরার সুবিধার্তে খাটিয়ার সাথে লম্বা বাঁশ বেঁধে নিয়ে জানাজার স্থলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য এখনো স্মৃতির মানসপটে ভেসে ওঠে। তিনি রেখে যান অসংখ্য স্বজন, গুণগ্রাহী, শুভানুধ্যায়ী।
তাঁর ইন্তেকালের পরের বছর ১৯৮৬ সালে তাঁর সম্মানে রাউজান ”মদেরমহল” নামে পরিচিত রাউজান বাসস্ট্যান্ডের নাম “জলিল নগর বাসস্ট্যান্ড” নামকরণ করা হয়। তাছাড়া তাঁর স্মৃতির স্মরণে পাঠাগার, মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্টান ইত্যাদি প্রতিষ্টা করা হয়।
আজ ৩৭ তম ওফাতবার্ষিকীতে
হযরত আবদুল জলিল মুহাম্মদ মহিউল ইসলাম (রঃ) এর বর্ণিল ও কর্মময় জীবন ও কৃতিত্ব শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে উঁচু স্থান দান করুন।
আমিন।
—
মোঃ নাজিম উদ্দিন
১১ আগষ্ট ২০২২
(তথ্যসূত্রঃ
১) সৈকতে ঐকতান ২০১১ ও ২০১৭
২) রাউজান কলেজ: গৌরবের ৫০ বর্ষ পূর্তি স্মারক
৩) অধ্যাপক ফয়েজুল ইসলাম ও অধ্যাপক শামসুল আনোয়ার জামালের লেখা
৪) আমার দাদী মরহুম ছফুরা খাতুন ও বাবা মরহুম মোঃ আজিমুল হক থেকে শ্রুত তথ্য ইত্যাদি)
আমার উপরের লেখার তথ্য ও তত্ত্বে কোন ভুল পরিলক্ষিত হলে সংশোধন করে দিলে কৃতার্থ হবো।