মানবিকতার চারপাশ, চারপাশের মানবিকতা

Nov 12, 2020 | আত্মউন্নয়ন ও মোটিভেশন | 0 comments

View : 136
 

মানবিকতার চারপাশ, চারপাশের মানবিকতা

‘মান’ আর ‘হুশ’ এ দু’য়ের সমন্বয়ে মানুষ। জল-স্থল-অন্তরীক্ষে মানুষই তার জ্ঞান-গরিমা, বিচার, বিবেকবোধ আর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মাধ্যমে উত্তোলন করেছে বিজয় কেতন। গুহা যুগ আর প্রস্তর যুগের Homo Sapiens আজ মানব সভ্যতার চরম উৎকৃষ্টতায় অতি আধুনিক বা অর্বাচীন।

এ মানুষ যখন যে অবস্থানে থাকে, সে অবস্থানকে সৌন্দর্যময় করার কথা এবং অনেক ক্ষেত্রে ঘটছেও তাই। তবে বাহ্যিক চাকচিক্যে যতটা না উন্নত হয়েছে মানুষ সভ্যতা, ঠিক তার সিকি আধুলী পরিমাণ মানবিক বা অভ্যন্তরীণ উন্নতি মানুষের হলে এ পৃথিবী অধিক নিরাপদ, প্রাণবন্ত এবং সত্যিকার অর্থে ‘সভ্য’ বাসযোগ্য হতো। মানবিক মানুষ ব্যতিরেখে সভ্যতার অস্তিত্ব কল্পনা করা বাতুলতামাত্র। মানুষের মানবিক মূল্যবোধের আধিক্য যেখানে ‘সভ্য’ তা-ই।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নয়নজুড়ানো নান্দনিকতার মাঝে অদৃশ্য ‘মূল্যবোধ’র কথা কিছুটা সেকেলে যারা ভাবেন, এ কথাগুলো তাদের জন্য নয়। এ আলোচনা তাদের জন্যই যারা চান এ ক্ষণিকালয় যেন চলমান আর আগামী স্বজনদের জন্য হিতকর হয়, হয় সত্যিকারের ‘সভ্য’।

আমি আপনি বাঞ্চনীয় মানবিক আচরণকে সাথে নিয়েই গড়তে পারি সে মানবিক সভ্যতা। সভ্য রাষ্ট্রের কথা উঠলে চলে আসে জাপানের কথা, ওয়েলফেয়ার ম্টেট বা কল্যাণকর রাষ্ট্রের কথা, তবে কোন মডেল বা excellence ই সীমারেখা দ্বারা বেষ্টিত নয়। আচরণ, ব্যবহারবিধি আর স্বচ্ছতার শুদ্ধাচার গড়ে দিতে পারে এ পার্থক্য।

বাসে বয়স্ক বা নারী-শিশুদের নিজের
আসন ছেড়ে দেয়ার মানসিকতা, পাশের সীটের মানুষের সাথে আচরণগত এবং ব্যবহারগত উদারতা ইত্যাদি যেন ‘সেই’ মানবিকতারই পরিচায়ক। সেরূপ গুণগত মানবিকতার স্তরে পৌঁছাতে না পারলেও অন্তত অতি শব্দে ফোনে কথা বলে পাশের জনের বিরক্তির বা সমস্যার কারণ না হওয়াও কম ‘মানবিক’ আচরণ নয়। এ উচ্চশব্দে অন্যের বিরক্তির কারণ হওয়া যেন বর্তমান পারিপার্শ্বিকতার এক দুঃসহ চিত্র। সাউন্ড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আমাদের জানার পরিধি কম। আমাদের দেশের লোকজন ফোনে যত সংখ্যক কল করি তার অর্ধেক কমে যাবে কল না দিয়ে এসএমএস দিয়ে যোগাযোগ করলে। শুধু ফোন এটিকেট পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করলে সাউন্ড ম্যানেজমেন্ট হবে কাঙ্খিত। পাশের জনের জন্য কম শব্দে ফোনে কথা বলা, কোন আয়োজনে উচ্চ শব্দে কথা বলা, উচ্চ শব্দে গান শুনে প্রতিবেশির শান্তি বিনষ্ট করার মতো অসৌজন্যবোধ শুধু বোধশক্তিই বিনষ্ট করো না, বরং মূল্যবোধকে করে অবক্ষয়।

নিজের দুহাত বিলিয়ে হাতে পত্রিকা পড়তে গিয়ে অন্যের গায়ে হাত লাগছে কি না সেটি ভাবার মতো সুক্ষ বোধসম্পন্ন মানুষও আছেন। আছেন প্রতিবেশির জন্য ভাবার মানুষও। বাড়ির বাইরের অংশে
বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করে তা দৃশ্যমান নোটিশ দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টাও মানবিক প্রতিবেশির হৃদ্যতার পরিচায়ক: সেদিন এক মসজিদের জুতা রাখার স্থান দেখলাম যেখানে নামাজ শেষে বের হওয়ার পূর্বে বাচ্চা মুসল্লিদের শেখানো হচ্ছে জুতা গুলো উল্টিয়ে রাখার জন্য, যাতে মুসল্লিরা বের হয়ে সোজা জুতা পড়ে হাঁটা শুরু করতে পারে।
একসময় হাতে লিখে ধর্মগ্রন্থ, লিখিত পত্রিকা, লিটল ম্যাগ নিজের সময় শ্রম ব্যয় করে অন্যের হাতে, ক্ষেত্রবিশেষে বহুক্রোশ দূরে পৌঁছে দিতেন কাতিব বা লেখকগণ; স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা বানানো, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের দ্বারা নিজের গ্রামের বা এলাকার স্কুলে অবৈতনিক পড়ানোর প্রথা ছিল চোখে পড়ার মতো। সামাজিক অনুষ্টানাদি সম্পাদন করতে বাবুর্চি বা বয়ের কাজ করতে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যেতো স্থানীয় ক্লাব, সংগঠনগুলোর সদস্যদের। এখনো সে ‘মানবিক’ সভ্যতা থাকতে পারেে অনেক গ্রামে, প্রকৃত সভ্যতায়।
মানুষ মারা গেলে জানাজা, দাফন, শেষকৃত্য ইত্যাদি কাজে বিনা পারিশ্রমিকে স্বেচ্ছায় দৌড় দেয়ার যুবা বা তরুণদের দেখা যাবে সানন্দে; সাম্প্রতিক করোনাকালেও এ মানবিক দৃশ্য সমৃদ্ধ করেছে মানবিক ভুগোলকে।

এখনো অনেক স্থানে আগুন লাগলে এলাকার লোকেরা নিজের ঘরে আগুন ধরলে যে দুঃশ্চিন্তায় আগুন নেভানোর চেষ্টায় থাকার কথা, ঠিক তেমন আন্তরিকতা নিয়ে দৌড় দেন। এ দৃশ্য স্বর্গীয়; যেন ‘স্বর্গ এসে দাঁড়ায় তখন আমাদের কুড়েঘরে’… ভ্যান বা টেলাগাড়ি দেখলে, রিক্সা ওয়ালা ছোট্ট ব্রিজে গাড়ি টেনে তুলতে না পারলে পেছন থেকে অমনি একজন এসে তার গাড়ি ধাক্কা দিয়ে সহায়তা করার দৃশ্য বেশিদিনের পুরানো নয়; তবে এ দৃ্শ্যে বেশিদিনের স্থায়িত্ব কাম্য।

মানবিক সভ্যতা বা বিশ্ব কোন ইউটোপিয়ার ভাবনা নয়; ছোট্ট
ছোট্ট কিছু অভ্যাসে, অন্যের জন্য চিন্তায় বদলে যেতে পারে আমার আপনার পারিপার্শ্ব; পরিবার, সমাজ, দেশ কিংবা সারা পৃথিবী। বনের কোন প্রাণী তেমন করে পাশর দাঁগায় না মানুষের, যেমনটি একজন মানুষ তার পাশের জনের জন্য ভাবেন, করেন, আসেন এগিয়ে…

মানবিকতার কাব্য রচনা করেছে মানবতার অনেক মহাকাব্য; সৃজন করেছে সহস্র পরার্থপরতার গল্প, সংলাপ। আমার এ চিন্তা কিংবা বাক্য কিংবা কর্মের কারণে অন্যের কোন ক্ষতি হচ্ছে না তো? কিংবা আমার ছোট্ট এ কাজে।অন্যের কিছু হলেও উপকার হতো— এসব প্রশ্ন মাথায় উদিত হলে বুঝবেন, ভবজগত হয়ে উঠবে সবচেয়ে মানবিক, সুহৃদ ও বাসযোগ্য।
কল্পিত বা কাল্পনিক নয়, স্পর্শসত্যে পর্যবসিত হবে এ বাসযোগ্য পৃথিবীর আজ ও আগামী, সৃৃৃৃজিত হোক মানবিক’ সভ্যতা।

 

—–

মোঃ নাজিম উদ্দিন

১২ নভেম্বর ২০২০