দাদীর স্মৃতি: দাদীর মৃত্যুর ২৩ বছর আজ..

Dec 14, 2024 | গল্প প্রবন্ধ উপন্যাস, ধর্ম, জীবন এবং জীবনভাবনা, মানুষ মানুষের জন্য | 0 comments

View : 32
 

দাদীর স্মৃতি: দাদীর মৃত্যুর ২৩ বছর আজ..

১৪ ডিসেম্বর ২০০১। রমজানের শেষ জুমা। সকাল নয়টার দিকের ঘটনা। আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজে অনার্সের ছাত্র। শহর থেকে ফিরেছি ক’দিন হলো। লম্বা ছুটি। কিছু কেনাকাটা করতে শহরে ছুটলাম বন্ধু দুলালসহ। বের হওয়ার সময় দাদি কোরআন শরীফ পড়ছিলো। সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ। শহরে যাচ্ছি শুনে বাড়ির সামনের ঘাটা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।

সারাদিন শহরে ঘুরাঘুরি শেষে বাড়ির অদূরে রমজান আলী হাট নামার সময় রাত প্রায় ১০ টা। কে একজন হাফেজ চাচার দোকানের কাছে বললেন, ওই যে, আজ যে বৃদ্ধা ইন্তেকাল করেছেন, তার নাতি এখন এসেছে। আমি হতভম্ব হয়ে হাফেজ চাচাকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি কিছু না বলে আমার হাত ধরে বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথোমধ্যে আরো একজন এবার স্পষ্ট করেই বললেন, আহা! ছেলেটা দাদীর জানাজা ও দাফনে থাকতে পারলোনা! তখন আমার বুঝার বাকি রইলো না, আমার প্রিয় দাদী আর নেই। দৌড়ে ছুটে গেলাম বাড়িতে। বাড়ির নতুন কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন দাদী ছফুরা খাতুন। সেই সকালেই যেন বিদায় পর্ব শেষ হয়েছিলো আমার সাথে।

#পরের দিন সকালে সবিস্তারে জানলাম, আমি সকালে বের হবার প্রায় ঘন্টাখানেক পর শরীর খারাপ লাগছে বলে বাড়ির উঠানের রোদে বসেছিলো দাদী। ঈদের ছুটি ছিলো বলে শহরের প্রায় সব আত্মীয় তখন গ্রামে। ডেকে আনা হলো ডাঃ আব্দুল আউয়াল ভাইকেও। কয়েকমুহুর্তের মধ্যেই আমার আম্মা এবং  নুর জাহান দাদী (বেগম সালাম সাহেব)ও অন্যান্য স্বজনদের সামনেই ইন্তেকাল করেন দাদী। সময় সম্ভবত সকাল ১০.৩০-১১টা।

#সে সময় আজকের মতো সবার হাতে মোবাইল ছিলোনা। যে ক’জন আত্মীয়ের বাসায় টিন্ডটি ফোন ছিলো, তাদের বাসায় খোঁজ নেয়া হয়। ঈদের বন্ধে প্রায় সবাই গ্রামে ছুটেছেন আগেই। জুমা থেকে আছর পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর বাদ আছর, রমজানের আলবিদা জুমার দিন দাদীর জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়।

#দাদী ছফুরা খাতুন আমার পরম সাহস ও প্রেরণার নাম। মোহাম্মদপুরেই ছিলো দাদীর বাপের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ি। মোহাম্মদ কালুর অন্যতম পুত্র-মরহুম ইজ্জত আলীর বড় কন্যা আর মোঃ কালুর অপর পুত্র আনসর আলীর একমাত্র পুত্র, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা দাদা আহমদুর রহমানের সহধর্মিণী ছিলেন দাদী।

#সরলমনা, ধর্মভীরু ছফুরা খাতুন এক অনুকরণীয় নারী। একাধিক পুত্র-কন্যার মৃত্যু তাকে করেছে শোকাহত; সবচেয়ে শোকের মুহুর্ত ছিলো চাচা রফিকের আনুমানিক ১০ বছর বয়সে পুকুরে পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনা। যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন পুত্রের ছোট লুঙ্গি আর গেঞ্জির স্পর্শ নিযে কাঁদতেন প্রায়শই।

#পড়ালেখার প্রতি দাদীর ছিলো বেশ ঝোঁক। হয়তো তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের আমলের সমাজের বাল্যবিবাহের প্রথা, নারী শিক্ষার প্রতি ২/৩ ক্লাসের পর পড়াশুনা চালানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার অন্যতম কারণ। এসব আনুমানিক ১৯৩০ এর দশকের কথা।

#দাদী ছিলো সহনশীলতা, ধৈর্যশীল এবং কর্মঠ সৃজনশীল রমণী। পরের ঘরে কী খাবার চলছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করতোনা কখনো। পরিবারের নিত্যকার চাষাবাদের সব কাজ সম্পর্কে ছিলো ভালো জ্ঞান। তাছাড়া, মাছ ধরার জাল বুনা, বেড়া, শীতল পাঠি বানানো, গোল বেড়া দিয়ে গাছ লাগানো ইত্যাদিতে দাদী ছিলো সুদক্ষ।

#আত্মীয় পরিজনের জন্য দাদী ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। সাত বোনের একমাত্র ভাই দাদা মরহুম আহমদুর  রহমানের সব বোনের সন্তানাদির আদর স্নেহমাখা উদ্যান ছিলো দাদীর মমতার আচল। নিজের ভাইপো ভাইজিদের জন্যও যেন মমতার বিরল পরশ। সবসময় ‘অফুত, দুউঅ ভাত হাই যা’ (হে বৎস, দু’টা ভাত খেয়ে যাও’) বলে আতিথেয়তার হাত বাড়াতেন এ রমনী। এ ‘ভাত খাওয়া’র জন্য ছিলোনা সুস্বাদু খাবারের পর্যাপ্ততা, তবে ছিলো নিখাদ আন্তরিকতা ও ভালোবাসা।

#দাদীর সারল্য বা প্রযুক্তি অজ্ঞতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। যেমন, অয়োময় নাটকে ‘রফিক’ চরিত্রের আবুল হায়াত যদি কোন নাটকে মারা যান, তাহলে পরের অপর নাটকে তাকে দেখলেই বলে উঠতো-‘এ লোক সেদিন মারা গিয়েছিলো: আজ আবার কীভাবে এসেছে?’!

#ধর্মকর্মের ব্যাপারে দাদীর ছিলো তীক্ষ্ণ সতর্কতা, মানুষকে সান্ত্বনা ও বুঝ দেয়ার ব্যাপারে ছিলো উদারতা, ধার দেনা দেয়ার ক্ষেত্রে ছিলো আন্তরিকতা, পতি ভক্তিতে ছিলো শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর সামাজিকতায় ছিলো অনন্যতা।

#দাদী সবসময় উপদেশের সুরে বলতো, মানুষকে খাওয়ানো অনেক বড় কাজ। দাতা গ্রহীতার চেয়ে বড়ো। মানুষকে দান করবে। ছোট থাকার গুণ অগণিত। ছোট এর জায়গা সর্বত্র। বড় বা দাম্ভিকের জায়গা কোথাও নেই।

#নাতী-নাতনীদের প্রতি দাদীর স্নেহ ভালোবাসা ছিলো অকৃত্রিম, অপরিসীম। তখনকার অভাব সংকটের রাজত্বে দাদী ছিলো ভালোবাসা রাজ্যের সম্রাজ্ঞী। নিজে না খেয়ে আমরা নাতী নাতনিদের জন্য নিয়ে আসতো কোন আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্টান থেকেও। কখনো শাড়ির আচলে ঢেকে, কখনো মুষ্টি করে। শুধু দিয়েই গেছেন আমাদের। অনেককিছু।

#আজ দাদী নেই। ২৩টি বছর। কিন্তু দাদীর স্মৃতি আমার হৃদয়ে অম্লান, অমলিন। আমাদের জন্য দাদী দোয়া করেছেন। আল্লাহর রহমত, দাদা-দাদী, মা বাবার, স্বজন, মুরুব্বিদের দোয়া আমাদের পাথেয়, আমাদের প্রেরণা। আমাদের শক্তি।

আজ আমি আমার মমতাময়ী দাদী মরহুমা ছফুরা খাতুনের মাগফেরাত কামনা করি। আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করি, আল্লাহ যেন দাদীকে জান্নাতে সর্বোচ্চ স্থানে আসীন করেন।

আমিন।


মোঃ নাজিম উদ্দিন
১৪ ডিসেম্বর ২০২৪