দাদার কাছে শেখাঃ -০১
দাদা মরহুম আহমদুর রহমান। আমার জীবনের কৈশোর শৈশব যাঁর আদর, পরশ, শাসন, বচনে ধন্য। দাদার জীবন আমার শৈশবে পাওয়া জীবনমুখী অনুপ্রেরণার নাম, জীবনবোধ গঠনে প্রথম পরশপাথরের সমার্থকতাও।
ব্রিটিশ আমলে মাত্র প্রাইমারি সমাপ্ত করে পুলিশের চাকুরিতে যোগ দেয়া দাদা ছিলেন অভাব অনটনেও নিজের ব্যক্তিত্বসুষমা ধরে রেখে, নিজের মূল্যবোধ, নিজের স্বকীয়তা ইত্যাদি বজায় রাখার এক অনুপম উদাহরণ।
আজ দাদার মৃত্যুর প্রায় ২৫ বছর পর দাদার জীবন ও কর্ম বিশ্লেষণ করলে যে ক’টি শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার কথা ভেসে আসে, তার কয়েকটি সংক্ষেপে নিচে তুলে ধরলামঃ
১) জীবন কর্মময়। পুলিশের চাকুরিতে থাকাকালীন ছুটিতে আসলে দাদা চাষাবাদ, গবাদিপালন ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত থাকতেন। কখনো অলস বসে থাকাে পাত্র ছিলেন না। অলস মানুষকে তিনি পছন্দ করতেন না।
২) পরিশ্রম সম্মানের, তা সে যে কাজের হোক। এ বোধ লালন করতেন সারাজীবন। চাকুরি থেকে অবসরের পর দাদাকে কখনো চাষের কাজে, কখনো মাছ ধরা, কখনো ছনের চাউনি দেয়া, কখনো অতিরিক্ত চাল ইত্যাদি বিক্রি করে বাজার করা ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকতেন। এমনও দেখা যেতো, বাটার সেন্ডেল বা চপ্পলের ফিতা ছিঁড়ে গেলে নিজেই গুনা তার গরম করে সেন্ডেল মেরামত করতেন। তিনি বলতেন, কোন কাজকেই কখনো ছোট বলে অবহেলা করা উচিত নয়।
৩) আমি যা, আমি তা-ই। চরম অনটন বা সংকটেও লোকদেখানোতে নিজের ব্যক্তিত্বকে বিকিয়ে দিতেন না কখনো। একবার দাদার বড় নাতি শওকত ওসমান ভাই দুপুরে দাদাকে দেখতে বেড়াতে আসেন। দাদা তখন ভাত খাচ্ছিলেন সামান্য কচু সবজি দিয়ে। বলা বাহুল্য, আমাদের ছোটবেলার সে অভাব সংকটের জীবনে সব খাবার আইটেম নিজেদের দ্বারাই উৎপাদন করা হতো। কচুও তেমনই।
নাতিকে দেখে দাদা খুশি মনে পাশে ডেকে বসিয়ে খেতে দিলেন। এতদূরের হালদা পাড় থেকে আসা বড়বোনের নাতিকে দাদা সে কচু সবজি দিয়ে খেতে বসিয়ে দিতে দেখে দাদী ইতস্তত বোধ করলেন এবং ইশারায় কোন প্রতিবেশি থেকে কিছু আইটেম আনতে যেতে উদ্যত হন। দাদা বিষয়টা বুঝে সশব্দে বললেন, আমি যা খাই, আমার নাতিও তাই খেতে পারবে, কারণ সে আমার নাতিই। দাদর মৃত্যুর পর যতবারই দেখা হতো, শওকত ওসমান ভাই এ কথা বলে দাদাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
৪) দাদা বলতেন, নিজের চেয়ে বেশি জানা মানুষের সাথে সম্পর্ক বাড়াবে। তোমার বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর পাশাপাশি তোমার অগ্রজ বা যারাই তোমার চেয়ে বেশি জানেন, তাদের সাথেও সম্পর্ক তৈরি করিও।
৫) আমার নাতি নাতনিদের পড়াশুনাই বড় স্থাবর অস্থাবর সম্পদ। একদা অবসরপ্রাপ্ত “হ্যাড অব দ্য ফ্যামিলি” দাদাকে তার এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাতি নাতনিদের জন্য যে কোন সম্পদ রেখে যাচ্ছোনা, তাদের ভবিষ্যত কী হবে। দাদা আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিলেন, অন্য সম্পদের প্রয়োজন নেই। নাতি নাতনিদের লেখাপড়া করাচ্ছি। সেটাই বড় সম্পদ। তাছাড়া এ সম্পদ কেউ উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত সম্পত্তির মতো ভাগও করতে পারবেনা।
—-
চলবে…
—
মোঃ নাজিম উদ্দিন
সেপ্টেম্বর ৭, ২০২২