আমার দাদা মরহুম মো: আহমদুর রহমানঃ ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ

Aug 19, 2021 | গল্প প্রবন্ধ উপন্যাস, ধর্ম, জীবন এবং জীবনভাবনা | 0 comments

আমার দাদা মরহুম মো: আহমদুর রহমানঃ
২৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ

——
১৯ আগষ্ট, ১৯৯৭। মঙ্গলবার রাত আনুমানিক ৮.০০ টা। রাউজান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মুমূর্ষ দাদার চিকিৎসা চলছে। রাত ঘনিয়ে আসতেই দাদার অবস্থার অবনতি ঘটতে লাগল ক্রমশই।

আমার বয়স তখন ১৬, সদ্য এস এস সি পাশ করলাম (৮ জুলাই ফলাফল পেয়েছিলাম)। তখনো আমার তেমন কিছুই বুঝে আসল না; শুধু মনে হল রাতে কি দাদাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারব তো। আমি ধরেই নিয়েছিলাম – দাদা তো সুস্থই হয়ে উঠবেন।

রাত ৯ টার দিকে সবার হুড়াহুড়ি দেখে আমিও হাসপাতালের ভিতরে গেলাম। দেখলাম এক পাশে ডাক্তার দাদার বুকে বিভিন্নভাবে দেখছে আর অন্যদিকে আমাদের মক্তবের হুজুর এবং আমার শ্রদ্ধেয় আরবি শিক্ষক হাফেজ আহমদ হুজুর- দাদার পাশে সম্ভবত কালেমা ও এস্তেগফার পড়ছেন। কিন্তু দাদার অবস্থা ক্রমেই নিস্তেজতার দিকে এগুচ্ছে, সেটা বুঝা যাচ্ছিল।

হঠাৎ আমার চোখ পড়ল দাদার বুকের দিকে, সেখানে একটু একটু যেনো নড়ছে। ক্ষণিকের মধ্যেই সেই নড়াচড়া গলার দিকে উঠতে লাগলো; জীবনে প্রথম এই ঘটনার দর্শনে আমি হতল-বিহবল। এই অবচেতনা কেটে গেল মুহুর্মুহু  চিৎকার আর কান্নায়। ওই নড়াচড়া আর নেই, ডাক্তার দাদার মাথার নীচে থাকা বালিশটাও নিয়ে নিল। আমার তখনো কান্না আসেনি, কিন্তু পরক্ষণেই সম্ভিত ফিরে ফেলাম। বুঝলাম, আদর স্নেহময় প্রিয় দাদা আ-র আসবেনা, কোন দিনও না; ততক্ষণে আমার পাশে আমার এক চাচা, আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, চলো, তোর দাদাকে নিয়ে বাড়িতে যাই। তখনো আমার অশ্রু আসেনি।

যোগাযোগ ও টেলি সংযোগ ব্যবস্থায় অনুন্নত সেই দিন গুলোতে সমাজের লোকজন মাইকে এবং লোক পাঠানোর মাধ্যমে নিকটজনদের খবর পাঠালেন।
পড়দিন দুপুরে জানাজা।আমাকে বলা হল খাটিয়ায় রাখা মুর্দার উপর ছাতা ধরতে যেহেতু আমিই বড় নাতি ছিলাম। তখনো শেষ বিদায়ীর জন্য কান্নার রোল আমি দেখিনি।
তখনো বর্ষার ঝর ঝর বৃষ্টি ছিল। কবরটাতে পানি ছিল, শুকানো হয়েছিল।

জানাজা শেষ হল। দাফনের সময় আবার কে একজন আমায় ডাকলো, কবরে একটু মাটি দিতে।
কবরের পাশে থেকে দেখলাম, তখনো পানি রয়েই গেল। লোকজন আবারো পানি উপরে ফেলছে। আরে, এই পানির মধ্যেই আমার দাদাকে কবরে দেয়া হবে? চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিলাম আর কান্নায় ভেংগে পড়লাম।কেউ কেউ আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। অবশেষে দাফন শেষ হল,
কবরের পানি শুকানো হল, কিন্তু আমার চোখেরজল তখন আর শেষ হচ্ছিল না।

সেই দিন ছিল ২০ আগষ্ট, বুধবার, আজ ১৯ আগষ্ট, বৃৃহস্পতিবার। বারের হিসাব হয়তো কাছাকাছি মিলে যায়, কিন্তু এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আর এই ধামে যে আর কোন হিসাবেই আসার সুযোগ নেই, সেই অংক কি আর কেউ মিলাতে পারবে???

আজ আবার বৃষ্টি, পানিময় কবরস্থানে কত মানুষকেই কবর দিতে হয়, হচ্ছে, তার ইয়ত্ত্বা নেই।

দাদা আমার জীবনের অন্যতম আদর্শ, মডেল। পরিবারে সাত বোনের একমাত্র ভাই দাদা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের একজন সামান্য কর্মকর্তা, কিন্তু ১৯৮১-৮২ সালে অবসরে যাওয়া এই কর্মবীর আমাদের সেই সংসার জাহাজটা টেনে নেয়ার জন্য যে কষ্ট করেছেন, কখনো স্রোতের প্রতিকূলে, কখনো অগভীর পানিতে-তা অসামান্য।

একদিকে সাত বোনের  অকৃত্রিম বন্ধনের তাগিদ, সিলেট- হবিগঞ্জ ইত্যাদি দুরবতী জেলায় চাকুরী, একমাত্র সন্তান বাবার পড়াশুনা ইত্যাদির পর আমরা সাত ভাই বোন কে এত অসাধারণ মমতার বাঁধনে রাখার যে দৃঢ়তা, তা আজ প্রায় দেড় যুগ পর ও ভোলার মত নয়। রাউজান গুজরা-আজিমের ঘাট এলাকায় বড় বোন ওমদা খাতুন, ইয়াসিননগরে মসুদা খাতুন, হাটহাজারী গড়দুয়ারায় মোমেনা খাতুন, বাড়ির পাশের ঘরের হাজেরা খাতুনসহ দাদার সব বোনের বাড়িতে আমাদের সাথে নিয়ে বেড়াতে যেতেন- বেশির ভাগ পথ তখন হেঁটে যেতে হতো। সে কী বাঁধন! সে কী হৃদ্যতা!

অভাবের সংসারে টানাটানি ছিলো, ছিলো সংকট, কিন্তু পরিশ্রমী দাদা আহমদুর রহমান কখনো দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। হয়তো  Hamingway’র সেই উক্তিটি ধারণ করেছিলেন সত্যিকারের হৃদমন্দিরে- ‘Man can be destroyed, but not defeated’। শরীরটাও ছিলো তেমনই প্রতিকী- কখনো নুয়ে পড়েননি, মৃত্যুর আগেরদিন পর্যন্ত কখনো লাঠি হাতে নিয়ে হাঁটেননি।

আর তাই তো, পুলিশের চাকুরি শেষে অবসর জীবনে কখনো এক মুহুর্তের জন্যেও বসে থাকতে দেখিনি দাদাকে। দেখিনি কোন কাজকে কখনো ছোট বলে জানতে- কে কী বলবে- এ লোকলজ্জা ছিলোনা বলেই হয়তো এ সাবেক পুলিশ মাঠে কখনো চাষা, কখনো জেলে, স্থরে কখনো কারিগর, কখনো জাল বুননকারী, কখনো বাজার খরচের জন্য হাটে মৌসুমি চাল বিক্রেতা ইত্যাদি। শনিবার আর বুধবার হাটের দুই দিন বাজারের থলে নিয়ে দাদার সাথে থাকতাম। দাদা প্রতিটি আইটেমের দাম কমপক্ষে তিন জন বিক্রেতার কাছ থেকে যাচাই করতেন। বাজার নিয়ে আসার সময় আমাকে প্রায়ই ১ টাকা হাতে দিতেন।

আবার সামাজিক আচার-অনুষ্টানেও ছিলেন দায়িত্ববান; পান চল্ল্যা, বিয়ে-আকদ বা প্রতিবেশির মৃত্যুসংবাদে ছুটে যেতে দেখেছি সবসময়। পানচল্লায় আমাকেও অনেকবার নিয়ে গিয়েছেন- নিজের জন্য পাওয়া বেলা বিস্কুট আমার হাতে গুঁজে দিতেন। সন্ধ্যার পর রাত ৯ টা পর্যন্ত দাদার সাবেক সহকর্মী ও মুনাফ বাড়ির প্রতিবেশি নুরুল আবসার দাদার দোকানে বসে গল্প আড্ডায় ব্যস্ত থাকতেন।

আমাদের জন্মের বছরে (সম্ভবত ১৯৮০/৮১ সালের দিকে), চাকুরি থেকে অবসরের সময়ে পেঠের কঠিন রোগে ভুগেছেন দাদা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে অস্ত্রোপাচার হয়। তখন ডাক্তার হারুন চাচা সম্ভবত সবেমাত্র মেডিকেশমলে পড়াশুনা শেষে করে ‘ডাক্তার’ নাম যোগ করছিলেন মাত্র। দাদার চিকিৎসা, অপারেশন, ফলো আপ ইত্যাদি নিজেই সামাল দিতেন- দাদা এ কথা কখনো ভুলেন নি। সালাম দাদা আর সোবহান দাদাদের বাসা থেকে নিয়মিত খাবার পাঠানো হতো। সালাম দাদা, সোবহান দাদা, নুরুল ইসলাম দাদাগণ ছাড়াও মামুন চাচা, খোকন চাচা, মুবিন চাচা, এনাম চাচা, আবসার চাচারা যেতেন মেডিকেলে- এ কথা দাদা ও দাদী সবসময় কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করতেন।
দাদার আপন চাচাতো বোন ছফুরা খাতুন ছিলেন দাদার সহধর্মিণী। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় পূর্ণ ছিলো তাঁদের দাম্পত্য জীবন।

১৯৯৭’র সম্ভবত জুনে আমার এসএসসি শেষ হওয়ামাত্রই একটা ছাত্র পড়ানো শুরু করেছিলাম; মান শেষে প্রথম আয় ১০০ টাকা হাতে পেলাম। তার মধ্য থেকে ৫০ টাকা নিজের আনন্দের আতিশয্যে দাদার হাতে দিলাম। দাদার চোখ তখন আনন্দাশ্রুতর চলচল করেছিলো, তা বুঝতে দেননি। কিন্তু রাতে দাদার শ্যালকসম্বন্ধ্যীয় আলহাজ্ব এমএ সালাম দাদার বাড়িতে (বিল্ডিং বলতাম আমরা) সবার সামনে সালাম দাদাকে এ টাকা পাওয়া নিয়ে বলেন, আমার নাতি তার প্রথম আয় থেকে আমাকে আজ ৫০ টাকা দিয়েছে- এটা আমার কাছে ৫০ টাকা নয়-৫০ লক্ষ টাকার চেয়ে বেশি। সালাম দাদা মৃত্যুর আগে বেশ কয়েকবার কথাটি আমাকে জানিয়েছেন- বলেছেন-‘তোর দাদা তোকে অনেক দোয়া করে গেছেন সেদিন’।

দাদারা শুধু দিয়েই যান- স্মৃতিটুকু রেখে যান। আমাদের ৭ ভাই বোনের পড়াশুনাব্যয় পেনশনভুগী দাদা আর কৃষক বাবার পক্ষে সত্যিই কঠিন ছিলো। দাদা নিজের একমাত্র সন্তান (আমার বাবাকে) তেমন ভারি দায়িত্ব দিতেন না। ধারদেনা মেটাতে একটা জমি বিক্রি করতে উদ্যত হলে একবার এক প্রতিবেশি দাদাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জমিটা বিক্রি করে দিলে তোমার নাতি নাতনিদের জন্য সয় সম্পত্তি কি রেখে যাবে?’ আত্মবিশ্বাসী দাদা উত্তর দিলেন, ‘তাদের লেখাপড়া করাচ্ছি’- এটাই সবচেয়ে বড় সম্পদ’। কষ্টে থাকলেও নিজের যা আছে- তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার শিক্ষা দাদা সবসময়, সব কাজের মাধ্যমে, আচরণের মাধ্যমে দিয়েছেন- আমরা তা জীবনে প্রতিস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছি- হচ্ছি।

আজ দাদা নেই। জ্ঞান তেমন অর্জন করতে না পারলেও প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আল্লাহর রহমতে দাদার প্রায় সব নাতি-নাতনির হয়েছে- কবর থেকে হয়তো এ দৃশ্য দেখেই হয়তো দাদা তৃপ্তি পাচ্ছেন।

আল্লাহ আমার দাদাকে বেহেশতে উঁচু স্থান করুন, আমিন।

—————
মোঃ নাজিম উদ্দিন
১৯ আগষ্ট ২০২১

লেখাটি লিখেছেন