বদর দিবসের স্মরণ

Apr 28, 2021 | ধর্ম, জীবন এবং জীবনভাবনা | 0 comments

বদর দিবসের স্মরণ।

১৭ রমজান। ইসলামের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি দিন। রমজানের রোজা ফরজ হয়েছে হিজরী দ্বিতীয় সন থেকে; সে বছরই রমজান মাসের ১৭ তারিখে সংঘটিত হয়েছে জঙ্গে বদর- ইসলামের প্রথম ন্যায় অন্যায়, সত্য-মিথ্যার পরককারী যুদ্ধ, ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষার প্রথম রক্তঝরা সংগ্রাম। ১৭ রমজানকে এ জন্য বদর দিবসও আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে।

ইতিহাসে দেখা যায়, মহানবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতের পর দীর্ঘ ১৩ বছর অতিবাহিত করেন মক্কা মোকাররমায়। এরপর তিনি আল্লাহর হুকুমে মক্কায় বসবাসরত সাহাবিদের নিয়ে পর্যায়ক্রমে মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের ২য় বছরেই নবীজীর নেতৃত্বে গঠিত মদিনা রাষ্ট্রটি মক্কার কাফের শক্তির পক্ষ থেকে হুমকির সম্মুখীন হয়। সিরিয়া থেকে ফেরার পথে মক্কার কাফেরদের একটি বাণিজ্য কাফেলা মুসলিম শক্তির প্রতিরোধের মুখে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে মক্কা থেকে এক হাজার কাফের সেনার একটি সশস্ত্র দল মদিনা থেকে ৮০ মাইল দূরে অবস্থিত বদর ময়দানে এসে যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু করে। এ অবস্থায় মাত্র ৩১৩ জন সাহাবিকে (যাদের মধ্যে মক্কা থেকে আসা মুহাজির ও মদিনায় বসবাসরত আনসাররা ছিলেন) নিয়ে বদর ময়দানের আরেক পাশে উপস্থিত হন শান্তি ও মানবতার নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)।

এ ছিল এক অসম যুদ্ধ। একদিকে সত্যের পক্ষে মাত্র ৩১৩ জন যোদ্ধা, প্রায় নিরস্ত্র। সঙ্গে দুটি ঘোড়া, ৭০টি উট আর যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অল্প কয়েকটি ঢাল-তরবারি। অপরদিকে সশস্ত্র ১ হাজার যোদ্ধা, মিথ্যার পক্ষে। তাদের নিয়ন্ত্রণে ১০০টি ঘোড়া আর ৭০০টি উট। যুদ্ধটি বিপুলভাবে অসম হলেও বিকাশমান মুসলিম শক্তির জন্য এ ছিল অস্তিত্ব রক্ষার এক মহাসংগ্রাম। সত্য-মিথ্যার সিদ্ধান্ত টানা এক লড়াই।

এ যুদ্ধে প্রিয় নবী (সা.) আল্লাহর দরবারে প্রার্থনায় লুটিয়ে পড়েন। হৃদয় উজাড় করে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকেন। আবেগ, কাতরতা, প্রেম আর আশ্রয়ের এক ভুবনজয়ী চেতনা থেকে তিনি প্রার্থনা করে বলেন—এ যুদ্ধে মুসলমানদের এই ছোট্ট দলটি পরাজিত হলে তোমাকে ডাকার মতো আর কোনো লোক দুনিয়ায় থাকবে না হে আল্লাহ! প্রিয়তম হাবিবের ডাকে সাড়া দিয়ে মাওলায়ে করিম মুসলমানদের বিজয় দান করেন। এ যুদ্ধে সাহাবি যোদ্ধা শহীদ হন ১২ থেকে ১৪ জন আর কাফেরদের মধ্যে উত্বা, শাইবা, আবু জেহেলের মতো শীর্ষ কাফেরসহ ৭০ জনের মতো নিহত হয়। বন্দি হয় আরও ৭০ জন।

এ বদর যুদ্ধের অভূতপূর্ব বিজয়ে মুসলমানদের ভিত দৃঢ়তর হয়। এরপরও মক্কার কাফের ও মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে মক্কা বিজয় পর্যন্ত উহুদ, খন্দক, খয়বরের মতো আরও কটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুসলমানদের নামতে হয় বাধ্য হয়ে। রাসুলের জীবদ্দশায় মক্কা বিজয়ের পরও আরও কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে ২য় হিজরির ১৭ রমজানে সংঘটিত বদর যুদ্ধের তাৎপর্য সবসময়ই অনন্য মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। বদর যুদ্ধে নিবেদিত মুজাহিদ সাহাবিদের সবসময়ই গণ্য করা হয় সবচেয়ে মর্যাদাবান শ্রেণী হিসেবে।

ইসলামের অস্তিত্বের প্রথম সকালে ধেয়ে আসা অন্ধকারের ঝড়ের মুখে আত্মনিবেদনের যে উজ্জ্বল অনুশীলন বদরের প্রান্তরে সাহাবিরা করেছেন, তার সঙ্গে রমজানের আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংযম ও আল্লাহর হুকুমের সামনে আত্মবিসর্জনের অপূর্ব এক সাদৃশ্য বিদ্যমান। ইসলামে জিহাদ যে কেবল জয়ের জন্য যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধপ্রস্তুতিমাত্র নয়, রক্ত ও মৃত্যুর বিভীষিকা যে জিহাদের মূল চিত্র ও চেতনা নয়, বদরের প্রান্তরে প্রার্থনার কান্না, যুদ্ধকালে রোজা রেখে ক্ষুধার্ত থাকা আর শান্তি ও সত্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ধরে রাখার মধ্য দিয়ে বদর যুদ্ধ তার এক উজ্জ্বল মানবিক রূপ উপহার দিয়েছে।
রমজান মনুষ্যত্ব ও আল্লাহর দাসত্বকে অস্তিত্বে ধারণ এবং লালন করার যে শিক্ষা দিয়ে যায়, রোজা ফরজ হওয়ার প্রথম বছর দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজানে তারই এক চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল। ইসলামের আত্মশুদ্ধি, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য, সাধনা, প্রার্থনা, সেবা, আত্মনিবেদন ও সংগ্রামের সব অধ্যায় যে একই সূত্রে গাঁথা, তার এক মহান স্বাক্ষর দ্বিতীয় হিজরির এই ১৭ রমজান। বদর দিবসের এই সামগ্রিক শিক্ষা বিকশিত হোক প্রত্যেক মুসলমানের অন্তর ও জীবনে।
বদরের যুদ্ধের মহান শহীদগণের মর্তবাও অনেক উঁচু স্তরে।
আজ এ মহান বদর দিবসের প্রাক্কালে প্রার্থনা করি- আল্লাহ যেন আমাদের সত্যের উপর অটল, মিথ্যার বিরুদ্ধে অনড় আর মানবতার জন্যে কোমল করে এ ধরাধামকে শান্তির উদ্যান করে দিন।
( অধিকাংশ তথ্যই সংগৃহীত)

মোঃ নাজিম উদ্দিন

লেখাটি লিখেছেন