প্রিয় স্বপন স্যারঃ এক আলোকিত শিক্ষাগুরুর স্মরণ

Oct 14, 2020 | মানুষ মানুষের জন্য, লেখক জীবন-জীবনী | 0 comments

প্রিয় স্বপন স্যারঃ এক আলোকিত শিক্ষাগুরুর স্মরণ

বাবু স্বপন কুমার বিশ্বাস: চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমান মোহাম্মদপুর স্কুল এন্ড কলেজ) এর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, সুদক্ষ প্রশাসক, দীর্ঘকালের সহকারী প্রধান শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের খুবই প্রিয় ও শ্রদ্ধার স্থল এবং বিদ্যালয়ের উন্নয়নকর্মের সারথি, এক কৃতী শিক্ষকের নাম।

১৯৯১ সালে রাউজান আর্যমৈত্রেয় ইনস্টিটিউশন থেকে প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে জানুয়ারী ১৯৯২ সালে মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে এক রোমাঞ্চ, ভীতি ও উত্তেজনার অনুষঙ্গে যে কয়েকজন শিক্ষককে শিক্ষক মিলনায়তনে প্রথম সালাম করলাম, তাঁদের মধ্যে প্রিয় স্বপন স্যার অন্যতম। সে ভয়ে দুরুদুরু মুহুর্তে আরো যে ক’জন উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা হলেন আমার শ্রদ্ধেয় দাদা আহমদুর রহমান, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বাবু অনিল কৃঞ্চ দাশ (তৎকালীন প্রধান শিক্ষক), মাওলানা ইসহাক, বাবু সন্তোষ চক্রবর্তী, মাওলানা কাজী আবদুস সালাম, মনসুর স্যার, হেলাল স্যার, নাজিমুল হোসেন হিরো, নুরুল আলম স্যার, জ্যোতিষ স্যার, মইনুল স্যার, ফিরোজ স্যার প্রমুখ। এ ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে “উচ্চ” বিদ্যালয়ে উড্ডয়ন যেন অজানা যাত্রাপথে রোমাঞ্চের উৎসরণের শুরুর অংশ।

তখন স্কুলের অবকাঠামোগত উৎকর্ষতা ততটা চোখে পড়ার মতো ছিলো না। তবে বিদ্যালয়ের মাঠ ছি্রর বরাবরের মতোই আজকের মতোই দৃষ্টিনন্দন, সুবিশাল।  নতুন স্কুল, নতুন ক্লাশ, নতুন পরিবেশে আমাদের বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবনের নীচ তলার সর্ব দক্ষিণের কক্ষে আমরা ৬ষ্ট শ্রেণির ক্লাশ শুরু করলাম। একে একে পরিচিত হলাম সব শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের সাথে। বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যময়, বিশেষ পঠনশৈলীর শিক্ষকদের আলাদা দৃষ্টিতে দেখা শুরু করলাম; আর এ বিশেষ ও স্বতন্ত্র পঠনশৈলী, বাচনভঙ্গি, গুরুগাম্ভির্য, সবল পাঠদান, জবাবদিহিতা ও আন্তরিকতার এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে বছর খানেকের মধ্যেই নিজের মন-মননে আলাদা স্থান দখল করলেন শ্রদ্ধেয় স্বপন কুমার বিশ্বাস তথা স্বপন স্যার।

শুরুর দিকে ইংরেজি ক্লাস নিতে আসতেন শ্রদ্ধেয় স্বপন স্যার; ইংরেজি গ্রামারের মূল বিষয়সমূহ অতি সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝাতে সক্ষম হতেন তিনি। স্যারের Punctuation শব্দটি উচ্চারণ করা নিয়ে ক্লাস শেষে আমরা বন্ধুরা বেশ মজা করতাম। যেমন, punc-পান্, tua -চুয়্যে, tion -শন.. তবে স্বপন স্যার তাঁর নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা ও নিয়মিত পড়া শেষ করার ব্যাপারে ব্যত্যয় কখনো মেনে নিতেন না। লম্বা বেতটা অমনোযোগী এবং শৃঙ্খলাভঙ্গকারী শিক্ষার্থীদের জন্য বরাবরই ব্যবহৃত হতো। সকালে পি,টি ও জাতীয় সংগীত চলাকালীন সময়ে সে বেত নিয়ে দাড়ানো শিক্ষার্থীদের লাইন সোজা করা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতেন। হেঁটে হেঁটে স্কুলের উপর-নীচতলায় বিশৃঙ্খলতা দূরীকরণ কী নিদারুন পরিশ্রমই না করতেন! দুপুুর ছুটির পর যারা স্কুল ফাঁকি দিতো, তাদের নাম লিখে রাখা হতো আর পরের দিন তার শাস্তি তো নিশ্চিত! আর দুপুর ছুটিতে ইকবাল করিম বা আমরা যারা কোন দিন বাড়ি না গেলে শ্রেণিকক্ষে বসে অধিক শব্দ করে দুষ্টামির খবর (ইকবাল করিমের ভান্ডারী গান বা মফিজের ‘আকা,, অ আকা- উর্দু গান এর শব্দ) জানলে স্বপন স্যারের বেত্রাঘাত হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেত না।

পুরানো ফনিক্স বাইসাইকেল, কালো চশমা,কালো চামড়ার ব্যাগ, ইন-করা ফুল শার্ট, কালো প্যান্ট, বেল্টের চাপেও বের হয়ে আসা কিছুটা মোটা পেটের দৃশ্য – যেন চোখে ভাসছে এখনো। শুরুর দিকে ৬ষ্ট শ্রেণিতে ইংরেজির ক্লাস নিলেও ৭ম বা ৮ম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে গণিত বা বাংলা ব্যাকরণ কিংবা ভুগোল ইত্যাদি বিষয়ে স্যারের পারদর্শিতা চোখে পড়েছে। রুটিনানুযায়ী অনুপস্থিত শিক্ষকের ক্লাস নিতে এসেও তিনি সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিতেন। চক-ডাস্টার-হাজিরা খাতা ছাড়া কোনদিন ক্লাসে ঢুকতেননা। প্রায় সকল বিষয়ে পান্ডিত্য, পঠনশৈলীর স্বতঃস্ফূর্ততা বিমুগ্ধ করার মতো। উল্লেখ্য যে, আমাদের সময়ে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ প্রায় সকল বিষয়ে পাঠদানের দক্ষতা রাখতেন; জ্ঞানার্জনের প্রতি স্যারদের ঐকান্তিক আগ্রহেই হয়তো এগিয়ে থাকতেন তাঁরা। আমার জানামতে, স্বপন স্যারও বি, কম উত্তীর্ণ হয়ে বি,এড ডিগ্রী অর্জন করেছেন, কিন্তু তিনি একাধারে বাংলা ব্যাকরণ, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একই দক্ষতায় পড়াতে সক্ষম হতেন। বৈদ্যুতিক পাখাবিহীন সে সময়ের ক্লাসরুমে প্রায় পুরো সময় দাড়িয়ে, গরমের নিদারুন কষ্টেও কখনো দেখিনি বিরক্ত হতে।

ইংরেজি গ্রামার ক্লাশে Tense, Voice, Narration, Transformation of Sentences ইত্যাদি এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন যে এগুলো আর বাড়িতে পড়ার তত প্রয়োজন হতো না। পড়ানো শেষে চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ড একটা একটি লিখে জিজ্ঞাস করতেন। আর সেসব অনুশীলনে গ্রামারের প্রায় সব নিয়ম চলে আসতো- যেমন, Changing Narration ক্লাসে বোর্ডে লিখতেন-
* Rahim said to his friend,”I shall come to your village tomorrow”.
আমরা স্যারের নির্দেশে অনেক সময় বোর্ডেও লিখতাম:
Rahim told his friend that he (Rahim) would go to his (friend’s) home the next day.
ইতোমধ্যে শেখানো নিয়ম- 1st person subject অনুসারে, 2nd person object অনুসারে, third person কোন change নাই, tomorrow থাকলে the next /following day, come হলে go হবে -ইত্যাদি (সব মনে পড়ছেনা!) একটি উদাহরণেই তুলে আনতেন দক্ষতায়।

ক্লাসরুমের বাইরে স্বপন স্যার ছিলেন একাধারে দক্ষ প্রশাসক, আন্তরিক সহকর্মী, পিতৃতুল্য শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের আশ্রয়স্থল। ৯ম শ্রেণিতে থাকাকালীন বিজ্ঞানের গ্রুপ ক্লাশের কক্ষের সংকীর্ণতার দরুন সহপাঠীরা মিলে এক ধরণের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠতে একাট্টা হয়েছিলাম। তৎকালীন প্রধান শিক্ষক অনিল স্যার স্বপন স্যারের সমন্বয়ে খুব সুন্দরভাবে সামাল দিলেন বিষয়টি; যেন টানাটানির সংসারে সকল সন্তানকে বুঝিয়ে দিন পার করার মতো!

১০ম শ্রেণিতে থাকাকালীন পাশের বাড়ির বন্ধু মফিজের বাড়িতে দু’জনে মিলে স্যারের কাছে পড়তাম, তা প্রায় এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত। সময়নিষ্ট পরিশ্রমী স্বপন স্যার সন্ধ্যার পর পড়াতে আসতেন প্রায় একই সময়ে, প্রতিদিন। এসেই ব্যাগ থেকে হলদে রংয়ের টর্চলাইট চার্জে দিয়ে দিতেন। তারপর যতক্ষণ পড়াতেন, কোন ক্লান্তি নেই, নেই কোন তাড়া।

কোন মাসে প্রাইভেট ফি দিতে পারতাম, কোন মাসে পারতামও না। তবে এ নিয়ে স্যার কোনদিন আমাকে কিছু বলতেন না, বরং খুব ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য প্রেরণা দিতেন সবসময়। এদিকে সময় শেষে আবার সাইকেলে চড়ে ছুটতেন টর্চের মৃদু আলো ভেদ করে ছুটতে আঁধার রাতে গাঁয়ের মেটোপথ ধরে; এ যেন সূর্যোদয় থেকে রাত অবধি পরিশ্রমী জ্ঞানের ফেরিওয়ালার ক্লান্তিহীন  যাত্রা।

এসএসসির ফরম পূরণের সময় এলো। আমাদের এক বন্ধুর (নাম উল্লেখ করলাম না) ফরম পূরণের সব অর্থ জোগাড় হয়নি। সময় আছে আর একদিন। বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম স্বপন স্যারের বাড়ি গিয়ে স্যারের শরণাপন্ন হই। সেদিন সন্ধ্যার সময় ৪/৫ টা সাইকেল যোগে রাউজান সদর সংলগ্ন স্যারের বাড়িতে গেলাম। ন্যুনতম ফি দিয়ে আমাদের অস্বচ্ছল বন্ধুর ফরম পূরণের আশ্বাস দেন তিনি। তারপর সে কী আতিথেয়তা! স্যারের এ সহায়তা কখনো ভোলার নয়। এত করে বন্ধুটির ফরম পূরণ হয় যথাসময় এবং সে আমাদের সাথেই এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারলো।

ইংরেজি গ্রামার ক্লাসে স্যার Tense, Voice, Narration, Transformation ইত্যাদি এত।প্রঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন যে, তা আর বাসায় ততটা পড়তে হতো না। পড়ানো শেষে বোর্ডে অনুশীলনের জন্য প্রশ্ন লিখে একে একে সবার কাছে জিজ্ঞাস করতেন। মাঝে মাঝে আমাদের বোর্ডে গিয়ে লিখার আদেশ দিতেন।  যেমন, Changing Narration এ একটি প্রশ্ন লিখেন বোর্ডে:
Rahim said to him friend,”I shall come to your village tomorrow”.
আমরা লিখতাম,
Rahim told his friend that he (Rahim) would go to his (friend’s) village the next day.

অনুশীলনের প্রশ্ন এমনভাবে লিখতেন, যেন বেশিরভাগ নিয়মাবলি উঠে অাসতো:
Reporting speech এ 1st person থাকলে Reporting verb এর Subject অনুসারে পরিবর্তিত হবে;    2nd person Object. অনুসারে হবে, আর 3rd person কোন change নাই।
reporting verb past tense হলে,
Direct Narration এ come, go হবে, tomorrow থাকলে the next / following day হবে (সব মনে পড়ছে না!)..

আর আমাদের উত্তর সঠিক হলে খুব খুশি হয়ে উৎসাহ যোগাতেন, যা খুব উৎফুল্ল করতো আমাদের।

তেমনই স্কুলের ১ম ও ২য় সাময়িক পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখানো এবং সর্বোচ্চ নম্বর অর্জনকারীর নাম জানার জন্য আমাদের উৎসুক পীড়াপীড়িতে স্যার উপরে বিরক্তি দেখালেও খুব খুশি হতেন; কে কত, কে সর্বোচ্চ নম্বর পেতো- তা জানানোর ভঙ্গিটা এমনই ছিল যে, আমাদের মধ্যে খুব ভালো করার প্রতিযোগিতা তৈরি হতো আপনা আপনিই।

পরীক্ষার ফল লাভের পর স্কুলে গিয়ে স্যারদের সালাম করার সময় খুশি ছিলেন সব স্যার। স্বপন স্যারও। তবে এক পর্যায়ে গণিতে আমার ৭৯ (তৎকালীন সিস্টেমে ৮০ নম্বর পেলে লেটার মার্কস অর্জনের সৌভাগ্য হতো)- পাওয়ার তথ্য জেনে স্যার তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো: ”তুই আজই পুননিরীক্ষণের আবেদন করবি”.. শিক্ষার্থীর অন্তপ্রাণ এমন আন্তরিক শিক্ষক এ যুগে রয়েছে কি না- আমার জানা নেই।

এসএসসি পরীক্ষার পর মাঝে।মাঝে স্কুলে যেতাম। স্যারের সাথে দেখা করতাম। ছোট বোনদের পড়াশুনার খোঁজ খবর নিতাম। কাঠের তৈরি হাত ওয়ালা চেয়ারের পেছনে তোয়ালে ঝুলানো থাকা সেই আসনে বসে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতেন স্যার। পরে খবর পেলাম, স্কুলে দীর্ঘ ৩০ বছরের অধিক শিক্ষকতা শেষে স্যার অবসর গ্রহণ করেছেন। উচ্চ শিক্ষা আর পেশাগত ব্যস্ততায় ততটা নিয়মিত। খবর নেয়া হতো না স্যারের। তেমনি কোন এক ভোরে খবর পেলাম, স্যারের ইহধাম ত্যাগের, এ পৃথিবী ছেড়ে চূড়ান্ত অবসরের! জীবনের প্রায় অধিকাংশ সময়েই মোহাম্মদপুর স্কুল এন্ড কলেজের জন্য উৎসর্গ করলেন এ শিক্ষানুরাগী।

আজ আমরা সবাই যে যার পেশাগত, সাংসারিক কর্মব্যস্ততায় সে প্রিয় স্বপন স্যারের বা পরিবারের খোঁজ নেয়ার ফুসরত পাই না কখনো। ইংরেজিসহ মূল পড়াশুনার ভিত্তি তৈরি করে দেয়া গাঁয়ের স্কুলের শিক্ষক স্বপন স্যারেরা হয়তো মরণোত্তর সম্মাননা পাবেন না,
কিন্তু আমরা বিদ্যা লাভ ধন্য শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন প্রিয় শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস।

স্যারের আত্মার কল্যাণ কামনা করি।

*******
মোঃ নাজিম উদ্দিন
(স্যারের ছাত্র)
lekhokbangladesh.com.
লেখকবাংলাদেশ.কম

লেখাটি লিখেছেন