পেছন ফেরার বিচিত্র তাগিদ

Nov 14, 2020 | গল্প প্রবন্ধ উপন্যাস | 0 comments

পেছন ফেরার বিচিত্র তাগিদ…


ছোট বেলায় সবাই চান বড় হতে আর ধীরে ধীরে পূর্ণবয়স্ক হলে সেই ব্যক্তিই ফিরে পেতে চায় তার মধুর শৈশব..
গ্রামে থাকতে থাকতে এক সময় যে কিশোর কি না “শহুরে” হতে চেয়েছিল, সেও আজ ইট পাথরের নগর ছেড়ে আবার সেই পল্লীমায়ের আঁচল বিছানো সেকালের “অজপাড়াগাঁয়ে” ফিরে যেতে চায়।

পেছন ফেরার প্রতি মানুষের এই চিরায়ত ঝোঁক বুঝতে পেরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের প্রতিষ্টাতা মার্ক জুকারবার্গও তার উদ্ভাবন ফেসবুকে চালু করেছে “মেমোরি:On this Day”.. এই দিনে আগের বছর বা বছরগুলোতে কোন কাজের পোস্ট দিয়েছেন, তা আপনার সামনেই নিয়ে
আসবে এই বিশেষভাবে… বছর কয়েক পর হওয়া পুরানো ছবি দেখেই আপনার মনে সুপ্ত বাসনা জাগে, ‘ইস, যদি সেই স্মৃতিময় দিনটা ফিরে পেতাম!’

দুরন্ত দুপুরে আবারো ছোটবেলার মত বাড়ির পুকুরে দিনভর সাঁতরাতে চায় তার মন!!! বড়বেলায়ও যেন থাকে তার শিশুবেলায় ফেরার বাসনা! যেনো Shakespeare এর ভাষায় এ যেন “second childishness”….

থ্রী স্টার বা ফাইভ স্টার হোটেলের আলো-আঁধারী লাল-নীল বাতির মাঝে শ্বেতপাথরের অদেখা ডাইনিং টেবিলে বসে মনকাড়া স্বাদের মেনু নিয়ে ছবি তুলে তৃপ্তির আস্বাদন নেয়ার বাসনায় থাকা সেদিনের নও স্মার্ট মানুষও আজ নিজের গ্রামের বাড়ি কিংবা কোন আত্মীয়ের গ্রামের বাড়ির উঠানে বা শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে কিংবা শীতলপাটিতে বসে হাতপাখায় বাতাস করে খাওয়ার দৃশ্য নিয়ে সেলফি দিতে চায়, চায় সেই গ্রাম বা শহরতলীতে check-in দিতে…যেন রবি ঠাকুরের ন্যায় “দাও ফিরে হে অরণ্য, লও এ নগর” আকুতি…

আরো এগিয়ে গেলে দেখা যায়, রুটি-রুজির সন্ধানে চামড়া-ফাটা গরম মরুভূমির দেশে কিংবা কনকনে শীতের বরফের পাশ্চাত্য-নগরে পাড়ি জমানো অনেক ভাগ্য অন্বেষণকারী এক সময় মনে মনে ভাবে, সব বাদ দিয়ে মা-বাবার ভিটে মাটিতে গিয়ে চারটা ডাল ভাত খেয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতাম! এ আফসোস আজন্মের!

কনের কাছে যেমন বাপের বাড়িতে যাওয়ার আকুলতা থাকে, তেমনি থাকে পাখিদের নীড়ে ছুটার দৌড়! খুব সুন্দর এক উপমাও দিয়েছেন এক কবি …নুরালি বাঁশীকে জিজ্ঞেস করা হলো, তোমার সুর এত করুণ কেন? বাঁশী উত্তর দিল, এই সুর ঘরে ফিরে যাওয়ার কান্নার অনুষঙ্গ! বাঁশ বাগান থেকে কেটে আনার পর সেই কচি বাঁশ চায় তার আসল বাড়িতে ফিরে যেতে, ব্যাকুল মনের নীরব কান্না প্রকাশ পায় মানুষের ফুৎকার দেয়ার উপলক্ষে.. সে কী সুর, করুণ, বেদনাতুর….

আরো কিছু পার্থিব ভাষায় “বেকুব” সাধক আছেন, যারা খুঁজে ফিরে সত্যিকার বাড়িতে, আসল বাড়িতে…
“বাড়ির পাশে” যে “আরশি নগর”, সেথায় বসত করা পড়শিকে দেখার জন্য কতইনা ব্যাকুলতা!

মহা বিশ্বের অযুত মিলিয়ন গ্রহ নক্ষত্রের মাঝে “পৃথিবী” নামের মাঝারি একটি গ্রহের এক তৃতীয়াংশের কিছু বাসযোগ্য স্থলে বাস করে আমরা অনেকেই নিজেদের রাজা, মহারাজা, অধিপতি, জমিদার, তালুক ভাবতে পারি; কিংবা মহাকালের তুলনায় শুধু ‘মিলি’ সেকেন্ডেরও কম সময়ের এই পার্থিব জীবনের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আমরা এই জীবনের সং‌ক্ষিপ্ততা ভুলে অনেক দিন বেঁচে থাকার মোহময় স্বপ্নে বিভোর থাকতে পারি; কিন্তু সত্যিকারের বিদগ্ধ সাধকগণ কিন্তু আসল জগতের, আসল বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রাণান্তর কামনা করে নিরন্তর।

“রাজেউন” শব্দ ডজনেরও অধিকবার পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করে এই আদি অনাদি সব কিছুর একচ্ছত্র মালিক যে আসল বাড়ির কথা বলেছেন, তার পানে ছুটে যাওয়ার মাঝে এই দুনিয়ার জীবন কত স্বল্প তা বুঝার জন্য জন্মের পর আজান আর সে আজানের নামাজ ইন্তেকালের পর জানাজার নামাজ সম্পাদনই যথেষ্ট।

মৃত্যুর পর যে মৃত্যহীন জীবনের শুরু, সে জীবনের আস্বাদন চায় স্রষ্টার প্রতি প্রেমে প্রেমময় সে সৃষ্টি। লওহে মাহফুজের আসল সৃষ্টি-স্থলের “স্থান-কাল”বিহীন সেই আবাসভূমে ফিরে যেতে চায় সে প্রেমে বিলীন আত্মা… স্বল্পদৈর্ঘ এই ভবজগতের প্রতি অনেকের মোহ থাকলেও আর সাধকগণ এই জগতের সকল জগতের চেয়ে জগতের মালিকের প্রতি প্রেমে থাকে নিবিষ্ট: তাদের সকল ভালোবাসা, সকল অপছন্দ হয় শুধু মালিককে সন্তুষ্টির প্রতি; তারা স্বর্গ চান না, স্বর্গের মালিককে চান।

পেছন ফেরার এ তাগিদ বড়ই বিচিত্র!
জীবনটা বড়ই অদ্ভুদ!

——
মোঃ নাজিম উদ্দিন

লেখাটি লিখেছেন