আমাদের শ্রদ্ধেয় পূর্বপুরুষগণ

Sep 12, 2020 | ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-রাজনীতি | 0 comments

আমাদের শ্রদ্ধেয় পূর্বপুরুষগণঃ
মৃত্যুর চিরন্তন সত্যতা ও কালের বাস্তবতা
—————————————————————————————————-

চট্টগ্রামের রাউজান সে সময় থেকেই ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক এক উপজেলা। প্রায় শতাব্দীকাল আগেও শিক্ষা-সংস্কৃতি-উৎকর্ষতায় রাউজান ছিল অনন্য, অগ্রগামী। মাষ্টারদা সূর্যসেন, কবি নবিনচন্দ্র সেনসহ অনেক দেশপ্রেমিকের জন্ম এ রত্নগর্ভা রাউজানে। ১৯৩২ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে প্রধান অতিথি করে সাহিত্য সম্মেলন করার ইতিহাস রাউজানের সংস্কৃতিমনা কীর্তিমান পুরুষদের। আর সে আয়োজনের প্রধান কুৃশিলব যখন আমাদের গ্রাম মোহাম্মদপুরেরই, তখন ভাবনা গৌরবেরও।

আমাদের পূর্বপুরুষগণের তৎকালীন মোহাম্মদপুর গ্রাম ছিল উন্নয়নশীল, তবে শিক্ষাসমাপনে চাকুরির চেয়েও বেশী প্রাধান্য পেত চাষাবাদ, পারিবারিক ব্যবসা ও বিদেশে চাকুরি, যেমন, সারেং বা অন্যান্য পদে রেঙ্গুনে বা করাচীতে যাওয়া ইত্যাদি। জমিদার বা তালুক, মাঝি (ব্যবসায়ী), সারেং (বা সারাং), পেশকার, সওদাগর ইত্যাদি তৎকালীন কর্মকান্ডের অন্যতম পদ বা ডাকনাম।
যতটুকু জানা যায়, মোহাম্মদপুরের বানু হাজি (যার নামে আমাদের বাড়ির বর্তমান নাম বানু হাজির বাড়ি) ছিলেন বংশের প্রধান, যার বেশ কয়েকজন পুত্র সন্তান ছিলেন, যাদের বংশের অন্যতম কিছু উত্তরসূরি হলেন হযরত আব্দুল জলিল মো. মহিউল ইসলাম (র.), ভাষা সৈনিক মরহুম অধ্যক্ষ শামসুদ্দিন মো. ইসহাক, হযরত আব্দুল বারী (র.), মরহুম ইকবাল আলী প্রমুখ।

বানু হাজির উত্তরসূরীদের মধ্যে একজনের ডাক নাম মোহাম্মদ কালু, যিনি পাঁচ পুত্রসন্তানের পিতা ছিলেন- আজগর আলী, ইজ্জত আলী, আনসুর আলী, জব্বার আলী ও মকবুল আলী। এই পাঁচ পুত্র নিয়ে তিনি বাড়ির দক্ষিণে বসবাস করতেন। এর মধ্যে মরহুম আনসুর আলীর পুত্র হলেন আমার দাদা মরহুম আহমদর রহমান, যিনি পেশাজীবনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পুলিশে চাকুরীতে ছিলেন।
১৯৯৭ সালে প্রায় ৭২ বছর বয়সে তার একমাত্র সন্তান আমার মরহুম বাবা মো.আজিমুল হক এবং তদীয় পৌত্রদের রেখে আহমদর রহমান ইন্তেকাল করেন।

অন্যদিকে উক্ত পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মরহুম ইজ্জত আলী ছিলেন তুলনামূলক অধিক শিক্ষিত, আধুনিকমনা ও দূরদর্শী। সমসাময়িক সমবয়সীগণ যেখানে রেঙ্গুনে জাহাজে খালাসি বা সারেং হওয়াটাই সর্বোচ্চ সোপান ধরে নিতেন, মরহুম ইজ্জত আলী নিজ শিক্ষা ও মেধার বলে তৎকালীন বার্মা ইষ্টার্ন বা পরবর্তী বিওসি-তে চাকুরি করেন, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। বলছিলাম ১৯৩০ দশকের গোড়ার দিকের কথা।
উল্লেখ্য, যুগের সচেতন আধুনিকমনা মরহুম ইজ্জত আলীর চার পুত্রের প্রায় সবাই প্রাতিষ্টানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন, যুগের পশ্চাদপদতায় ইজ্জত আলীর চার কন্যা প্রাতিষ্টানিক শিক্ষা বেশিদূর না পেলেও আমার দাদী মরহুম ছফুরা খাতুন ও তার সর্বকুকনিষ্ট বোন কুলছুমা খাতুন ছিলেন ধর্মীয় শিক্ষায় সুশিক্ষিত।

ইজ্জত আলীর জৈষ্ঠ্য পুত্র মরহুম এম এ সালাম (সাবেক বন্দর কর্মকর্তা) ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ, দূরদূর্শী ও সফল সমাজসেবক।মরহুম সালাম দাদা নিজের ৪ পুত্র ও ৪ কন্যা সবাইকে শুধুমাত্র সর্বোচ্চ ডিগ্রী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর অর্জনেই কান্ত হননি, বরং এলাকার দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিঃস্বার্থ সহায়তা করেন, এমনকি শহরে নিজের বাড়িতে রেখে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, যেমনটি হয়েছিল আমার ক্ষেত্রে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর অধ্যয়নের সময় আমাকে সালাম দাদা শুলকবহরস্থ নিজের বাড়িতে থেকে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। গ্রামই ছিল ‘সালাম সাহেব’র প্রাণ, আধুনিক মোহাম্মদপুরের শিক্ষা, চিকিৎসা, ধর্মীয় শিক্ষা, কৃষি ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ প্রায় প্রতিটি পরতে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জীবদ্দশায় ২য় পুত্র মামুন চাচার অকালপ্রয়াণ সালাম দাদার জন্য ছিল বড় ধাক্কা। ২০১০ সালে আনুমানিক ৭২ বছর বয়সে তিনি তার পুত্র ডাঃ আব্দুল্লাহ আল হারুনসহ ৩ পুত্র ইহকাল ত্যাগ করেন। একই বছর তার সংসারতরণীর মূলস্তম্ভ, অতি আন্তরিক সমাজহিতৈষী দাদী নুরজাহান বেগমও ইন্তেকাল করেন।
মরহুম ইজ্জত আলীর ২য় পুত্র আবদুস ছোবহান ছিলেন গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তা।অতি মেধাবী ‘সি এন্ড বি’র ছোবহান সাহেবর লেখনী ছিল অসাধারণ, যার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯০’র দশকের শুরুতে সরকারী চাকুরী থেকে অবসরের পরও ইলিয়াস ব্রাদার্স, ইক্যুইটিসহ বড় বড় কর্পোরেট হাউজগুলোতে তিনি ফ্রিল্যান্সিং করতেন, সসম্মানে, ২০০৮ সালে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত। অসাধারণ রসবোধ, বন্ধুবাৎসল্য, পরোপকারী ছোবহান দাদা গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের প্রিয় ছোবহান দাদা ছিলেন চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহের জীবন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া বা গুগল!

খুব স্নেহের বাঁধনে রাখতেন বলে
জীবন ও জগতের বিশাল জ্ঞান-অভিজ্ঞতার অনেক বিষয় সহজে, সরসে জেনেছি দাদার কাছ থেকে। আশার সঞ্চার করে মানুষকে জীবনবোধে, বেঁচে থাকতে ভরসা জোগাতেন।যেমন,আমার দাদার পর ২০০১ সালে দাদী মারা যাওয়ার পর সংসারখরচের তাগিদ ও চিন্তায় অনার্স ২য় বর্ষের এ ছাত্র যখন পড়াবিমুখকার চিন্তা করছিলাম, তখন তিনি নিজে এবং সালাম দাদা, ডাঃ হারুন চাচাসহ বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে নিয়ে আমাকে উচ্চ শিক্ষা সমাপনের এবং পরিবারের খরচ-ভরণ-পোষণ সংক্রান্ত দিক নির্দেশনা দিয়ে আমাকে পুনরায় আশাবাদী করলেন, যা এখনো আমায় সাহস যোগায়, আশাও। পরবর্তীতে তার প্রিয়তমা স্ত্রী অতি আন্তরিক, পরহেজগার অকৃত্রিম শুভাকাঙ্খী পরম আপনজন মজুনা খাতুনও ছেড়ে যায় এ ভবসংসার।
গ্রামের বাড়ির সুন্দর পারিবারিক কবরস্থানে কবরের সারিবদ্ধ নামফলক মনে করিয়ে দেয় সে সব অতি আপনজনের কথা।

দাদা নুরুল ইসলাম, দলিলুর রহমান, অলিউর রহমান, বাদশা মিয়া, রাজা মিয়া, চাচা গোলাফুর রহমান, আবদুল কাদের, আবদুল মালেক, মফজল চাচা, দিল মোহাম্মদ, নুর মোহাম্মদ, অকালে ঝরে যাওয়া খোরশেদ ভাই, দাদী-চাচী অনেকে আজ পরপারে, ক্ষণস্থায়ী বাড়ি ছেড়ে সত্যিকার স্থায়ী ঠিকানা পুকুর পারস্থ কবরস্থানে আজ।

বাবা, দাদা-দাদীসহ পরপারের যাত্রীদের এ চিরন্তন অবস্থান মনে করিয়ে দেয়- কত ছোট এ ভব সংসার, কত সংকীর্ণ এ জীবন, কত বাস্তব এ মরণযাত্রা!
বাড়ির সামনের এ কবরস্থান গ্রামে আসলে আমাদের প্রতিবারের জিয়ারতে মনে করিয়ে দেয়,আমরা উত্তরসূরীরাও তাদের পথ অনুসরণ করতে যাচ্ছি, কেউ আগে, কেউ বা পরে।
আজ সকল মরহুমের আত্মার মাগফেরাত ও জান্নাত কামনা করছি।

(জ্ঞানের অপ্রতুলতা হেতু বয়ঃক্রম অনুসারে সাজানো সম্ভব হয়নি)


মোঃ নাজিম উদ্দিন
nazim3852@gmail.com

লেখাটি লিখেছেন