Post View : 6
 

সব থেকেও যেন কিছু একটা নেই

—-

একটা কাঠের তৈরি ক্রিকেট ব্যাট। নিজেরা ঘরের কাঠ/তক্তা দিয়ে তৈরি করে সে ব্যাট দিয়ে, বাদাম গাছের চিকন ডাল দেয়ে স্ট্যাম্প বানিয়ে বছরের পর বছর ক্রিকেট খেলার প্রজন্ম জানে, কীভাবে সকল সংকটে থেকেও হৃদয়ের উচ্ছ্বাস, প্রশান্তি আনার মতো খেলাধুলা করতে হয়। আর আজকের প্রজন্মের একটি শ্রেণি সব উপকরণ পেয়েও যেন কিছুতেই পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি নেই।

একটা ডিয়ার বলে কয়েক বছর, একটা কেরামে যুগ পার করা প্রজন্মের ছিলো সংকট, অনটন, কিন্তু অভিযোগ ছিলো কম। সারা গ্রামে এক দুটো টেলিভিশন ছিলো (বেশিরভাগ সাদাকালো টিভি!)- এক বাড়ির ছেলেরা অন্য বাড়িতে গিয়ে, অনেক কষ্টে ঠাসাঠাসি করে টিভি দেখতে যেতাম, কিন্তু ঘরে টিভি নেই কেন, সেজন্য রেগে মেগে আগুন হয়ে যেতামনা!

বিনোদনের স্বল্পতা আমাদের মনকে সংকুচিত করতে পারেনি। আমরা প্রতি তিন মাসে একবার বিটিভিতে সিনেমা দেখেও ছিলাম পরিতৃপ্ত।
বিয়েবাড়িতে মেহেদি অনুষ্টানে মোটামুটি সামর্থবানদের ভাড়া করে আনা ভিসিআর/ভিসিডিতে ভাড়া করা সিনেমার ক্যাসেট ছাড়া হতো; তিন-চার বাড়ির দর্শকদের দেখার সুবিধার্থে উঠোনে রাখা টেলিভিশন দেখে আনন্দ উপভোগ করা তরুণ-যুবা কখনো পাটিতে বসে বা দাঁড়িয়ে রাত পার করেছে, কিন্তু অভিযোগ ছিলো না তেমন। বরং বাড়ি ফিরলে বাবা মায়ের বকুনি বা শাস্তির ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতো!

প্রতি বুধবার একঘন্টার ম্যাকগাইভার দেখে সারা সপ্তাহ প্রতীক্ষায় থাকার প্রজন্ম হতাশাকে জায়গা দিতো খুব কমই। শুক্রবারে আলিফ লায়লা, মঙ্গলবারে অয়োময়, কোথাও কেউ নেই বা সংশপ্তক নাটকের প্রতি আগ্রহ এমন ছিলো যে, কান কাটা রমজান, বাকের ভাই বা মজনু, বদিদের সব উক্তি (যাকে ‘ডায়লগ’ বলতাম) যেন মুখস্থই ছিলো। প্রতিদিন কেন টিভি নাটক নেই, নিজের ঘরে বা বাড়িতে কেন টিভি নেই সে নিয়ে বাবা মায়েদের কখনো অভিযোগ করতে কাউকে দেখতাম না। ধরেই নিতাম, এটাি আমাদের বর্তমান অবস্থা। জীবন যখন যেমন…

বরযাত্রীর সাথে কখনো হেঁটে, কখনো জীপের ছাদে বসে, বা বাসে দাঁড়িয়ে বিয়ে খেতে যেতে কী আনন্দ, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এখনকার প্রজন্ম কী কখনো সহজে মেনে নিবে? অভাবে সে যুগে, বিয়েতে ছোটদের একটা ডিমের অর্ধেক করে দেয়া হতো, মেজবানে ছোটদের চেয়ারে না বসিয়ে পাটি বিছিয়ে নীচে বসানো হতো, তবুও ছোটরা শিখেনি- ”আমি খাবোনা” বলা। তাদেরও ভালোবাসার প্রিয় বাবা মায়েরা ছিলেন। তারা কখনো অভিযোগ শিখাননি। তাই অন্য দশজন শিশু কিশোর তরুণের মতো বিত্তই -সামর্থ্য ভেদে সকলে একই আয়োজনে, একই পরিবেশনায় খেতে বসতো।

বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ বা বড়ভাইগণ শাসন করতেন। নির্দ্বিধায়। কোন অভিভাবক (বাবা -মা বা দাদা দাদী) কখনো সে শাসনে বাঁধা দিতেন না। মক্তব বা মসজিদ, স্কুল বা মাদ্রাসায় শিক্ষকগণ যা বলতেন, তা-ই হতো। শিক্ষকগণ বেত্রাঘাত করলে বাবা মা খুশি হতেন। বলতেন, স্যার, শুধু হাড্ডিটা থাকলে হবে। আর সেজন্যই তৈরি হয়নি অসন্তোষ, অভিযোগ, অনুযোগ বা প্রতিবাদি কৈশোর।

এ কালে সবই আছে। ঘরে ঘরে টেলিফোন। মোবাইল। ইন্টারনেট। গ্রামেও ওয়াইফাই সংযোগ। ঘরে ঘরে কেরাম, দাবা, লুডু। প্রত্যেকের কাছে আছে সুন্দর খেলাে উপকরণ, সরঞ্জামাদি। ঘরে ঘরে স্মার্টটিভি। কিন্তু কোথাও একটা ঘাটতি। শুন্যতাম। অন্তঃস্বারশুন্যতা।
অভাব তেমন নেই। কিন্তু পরিতৃপ্তি নেই। সংকট তেমন নেই। কিন্তু প্রশান্তি নেই। ঝগড়া তেমন নেই। তবুও অন্যকে মেনে নেয়ার মানসিকতা সর্বত্র নেই।
নিজের কোন কিছুর অভাব নেই। তবু্ও অপরের সুখে আনন্দিত হওয়ার মানসিকতা নেই। অপরের দুঃখে দুঃখিত হওয়ার অনুভুতি নেই।

সব থেকেও যেন কিছু একটা নেই।
কিন্তু কেন?


মোঃ নাজিম উদ্দিন
৫ জুলাই ২০২২