প্রসঙ্গঃ বই, পাঠাভ্যাস ও পাঠাগার

Sep 3, 2020 | বইমেলা, বুকরিভিউ, সম্মাননা | 0 comments

View : 142
 

রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, কিন্তু বইটি অনন্ত যৌবনা…ওমর খৈয়াম..
“বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না”- লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী…

কিংবা “Reading maketh a full man..” Francis Bacon…
জীবনের বিভিন্ন স্তরে বই নিয়ে এরূপ অমর বাণী আমরা জেনেছি, বুঝেছিও। বই বা পুস্তক, জ্ঞানের অন্যতম প্রধান বাহন।
একটি ভালো বই অনেক ভালো বন্ধুর সমান। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে সাথে রেডিও-টেলিভিশন, টেলিফোন-ফ্যাক্স-মোবাইল, ফোন, ইন্টারনেট, গুগল, নবনব সংযুক্তি, ইমেইল, টিউবলি, ইয়াহু, হটমেইল, ইউটিউব, সামাজিক ও পেশাগত যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, লিংকড-ইন বা অন্য বেশকিছু মাধ্যমে আজকের বিশ্ববাসীর মনোনিবেশ। মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্বের যেকোন প্রান্তে এমনকি সচিত্র কিংবা লাইভ যোগাযোগের যে অভূতপূর্ব মাধ্যমসমূহ উদ্ভাবিত হয়েছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর!

অবাধে তথ্যপ্রবাহের এ বিপ্লবে তথ্য ও তত্ত্বের প্রয়োজনে সফট কপি বা ভার্চুয়াল ভার্সনের কথা বলে, কাগজ বাঁচানোর কথা বলে বা গ্রিন এনভায়রনমেন্ট এর দোহাই দিয়ে জ্ঞানের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম বা বাহন বইয়ের বিকল্প (?) ভাবা শুরু করেছে একশ্রেণির অতি আধুনিক (!) মানুষ। হয়ত বইয়ের অতিসহজলভ্যতাও একটি কারণ!
কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ কত কষ্ট করেি না তথ্য প্রকিশ করত, তা প্রস্তর বা নব্য প্রস্তর যুগ কিংবা তারও আগের যুগ সমূহের দিকে আলোকপাত করলেই বুঝা যায়।

প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লামসহ সাহাবিগণ কত কষ্টে কোরআন সংগ্রহ, সংরক্ষণ করতেন-তা ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বুঝা যায়। কাগজকল আবিষ্কারের পর তা অনেকাংশে কমে গেলেও ফটোকপি মেশিন কিংবা ইন্টারনেট-ইমেইল বা ক্যামেরাসমেত মোবাইল আবিষ্কারের ঠিক পূর্বেও একটা মূল বইয়ের যে দাম ছিল – তা মানুষ শুধু কল্পনাই করতে পারে!

এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জ্ঞানপিপাসুগণ কখনো বইয়ের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন রাখেন নি নিজজেদের, কারণ এ বই-ই
বিংশ শতাব্দির শেষের দিককে প্রযুক্তির বর্তমান উৎকর্ষের পূর্বে বই সংগ্রহের উৎস, পাঠাগার ছিল কম। নির্দিষ্ট করে বললে, চট্টগ্রামে পাবলিক লাইব্রেরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে পাবলিক লাইব্রেরি, আমেরিকান সেন্টার, ব্রিটিশ কাউন্সিল ইত্যাদি। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক লাইব্রেরিগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।

তবে একালে “ছাপাখানার” আশীর্বাদে বই অনেক সহজলভ্য, সুলভও। একসময় কিছু রেফারেন্স বই এত একটির যেখানে হাজারের উপরে দাম ছিল, সেখানে শ’খানেক টাকা দিয়ে সে বইয়ের কপি পাওয়া যায় (কথিত নীলক্ষেত প্রিন্টের বদৌলতেও অনেকটা!)
এ যেন “এককালে ক্ষুধার অন্ন জুটিত না,আর এখন অক্ষুধা ও দৃষ্টিক্ষুধাও পরিপুষ্ট হয়”..

অথচ বইয়ের সহজলভ্যতার এ যুগেও বইয়ের কদর, ক্রয়, পঠন- এত আশংকাজনকহারে কমেছে, যখন বছরে একটি বই কিনেন না- তেমন পাঠকের (!) সংখ্যাই বেশী। আমাদের ছোটবেলায় দেখতাম, নজরুল-রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থ কিংবা কাসেম বিন আবু বকরের লেখা উপন্যাস বিয়েতে উপহার হিসেবে দেয়া হত। বিয়ের ইনসাইড কাভার পৃষ্টায় কলাম করা থাকত (উপহার দাতার নাম বিবরণী সহ)….

পশ্চিমারা যখন বইয়ের বিকল্প বই ছাড়া কোন কিছুকে দেয় না, প্রাচ্যের জাপানসহ অনেক দেশেই ট্রাভেলিং বা ভ্রমণে অত্যাবশ্যকীয় অংশ যেখানে বই, সেখানে পশ্চিমাসহ সেসকল উন্নত দেশের মত চলতে গিয়ে উল্টো তাদের ভাল অভ্যাসগুলো বাদ দেই! কী অদ্ভুত!
যেখানে ফেইসবুক প্রতিষ্ঠাতাদের দেশে এর ব্যবহার খুব কম, সেখানে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের অধিবাসীগণের একটা শ্রেণি ফ্রি টাইমের বেশীর ভাগই ব্যয় করে ফেইসবুকে! ফেইসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গকে এক অনাড়ম্বর অনুষ্টানে প্রশ্ন করা হলো- এত সৃজনশীল অভিনব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি কিভাবে উদ্ভাবন করলেন, আর এখন তেমন অভিনব কোন মাধ্যম উদ্ভাবিত হয় না কেন? হাসির ছলে ত্রিশের কোটায় থাকা তরুণ জুকারবার্গ বলেন, তখন আমরা সৃজনশীল চিন্তা করার সময় পেয়েছিলাম; আর ফেইসবুক উদ্ভাবনের পর এতে সবাই এতটাই মগ্ন, নতুন সৃজনশীল কোন চিন্তা করার সুযোগই তেমন পান না!” হাসির ছলে বলা হলেও কথাটার সত্যতা সহজেই অনুমেয়।
চিন্তা করার গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাসটা আর সুচিন্তাকে কাজে পরিণত করার শক্তি দান করে বই। মূলতঃ জ্ঞান-মানে-মননে-ধে বড় হতে গেলে বইয়ের কোন বিকল্প নেই।
আসুন, নিজের প্রাত্যহিক জীবনধারায় কিছুটা পরিবর্তন এনে বই কেনা এবং বই পড়াকে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করিঃ

# পাঠাগার বা লাইব্রেরীতে ঘুরতে যাই মাসে একবার হলেও। একসময় বইকেনার অভ্যাস অাপনা অাপনি তৈরী হবে। নতুন কিংবা অরিজিনাল বইয়ের বিশাল সম্ভার “বাতিঘর” কিংবা পুরানো বইয়ের জন্য “অমর বই ঘর” ইত্যাদি ভিজিট করুন। সবচেয়ে ভাল হয়, যেদিন টিউশনি বা চাকুরির বেতন পাবেন, সেদিন কাজটা করুন, তখন দু একটা বই কেনার ইচ্ছা অর্থনীতির ভাষায় “চাহিদা”তে পরিণত হবে। তবে আবারো আশ্বস্থ করছি, বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়না।

## বই পড়ার অভ্যাস করুন। তা ধর্মীয় বই,সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল কুরঅান, হাদিস (বাংলায়ও সহজলভ্য) ইত্যাদা হোক বা অন্য যে কোন বই হোক। দিনে অন্তত একপৃষ্ঠা পড়ুন, তাও না পারলে ৫-১০ লাইনের একটা অনুচ্ছেদ পড়ুন। এ অভ্যাসটা গড়ে তুলুন- প্রতিদিন আপনি পড়েন- নিজেকে স্বীকৃতি দিন।

### টোঙ্গা পাঠক হোন (সত্যিকার পাঠক ঝালমুড়ির টোঙ্গা পেলেও পড়েন)….কয়টা বর্ণে অর্থময় শব্দের যে গাঁথুনি, তা জ্ঞানের বিশাল রাজ্যের বেলাভূমিতে নিয়য়ে যাবে আপনাকে।

#### পড়ুয়া পাঠকদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলুন, সাক্ষাতে বা ফোনে হলেও। তার অনেক পড়া বইয়ের নাম শুনে নিজের অপর্যাপ্ত পড়া নিয়ে অনুশোচনা মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে আপনার জীবনে।

*#*# অন্যকে বই উপহার দিন। বিশেষ উপলক্ষে বা আপনার পঠিত বই মন্তব্যসহও দিতে পারেরেন। এতে বাড়ে হৃদ্যতা ও সুসম্পর্কও।

*####* নিজের একটি ছোট পাঠাগার তৈরী করুন। হোক তা ৫-১০টি বইয়ের। এ রাজ্য আপনার। সে রাজ্যের অধিপতা হয়ে নতুন নতুন বই সংগ্রহ করে রাজ্যের পরিধি বাড়ান। বাড়বে মননের বিস্তৃতি।

### সর্বোপরী, বই পড়ার অভ্যাস আপনাকে আপনার অজ্ঞতার গভীরতা জানাবে। এতদিন আপনি মনে করতেন, আপনি অনেক জানেন। এক একটি বইপড়া শেষ হলে জানতে পারবেন আপনার জ্ঞান কতটা কম! সক্রেটিসের যেমনটি বলে উঠবেন, আমি মাত্র জ্ঞান সাগরের বেলাভূমিতে পা রেখেছি!.

বই পড়ার মাধ্যমে নিজের অজ্ঞতার যে অবস্থান আবিষ্কার করবেন, তা যত আগে হয় ততই উত্তম। না জেনে লজ্জ্বা পাওয়ার চেয়ে জানার চেষ্টায় রত থাকা উত্তম।

সুবিশাল জ্ঞান-রাজ্যে অবগাহন করে নিজেকে জানুন, নিজের জন্য কিছু সময় রাখুন প্রতিদিন।

————–
মোঃ নাজিম উদ্দিন
nazim3852@gmail.com
চট্টগ্রাম -২৫-০৮-২০১৮