সন্ধ্যালোকের পূর্বক্ষণে

Oct 8, 2020 | ধর্ম, জীবন এবং জীবনভাবনা | 0 comments

সন্ধ্যালোকের পূর্বক্ষণে

———-

জীবনের ঊষায় কত রং বেরংয়ের কালি, তুলি নিয়ে স্বপ্নের সৌধ তৈরি করে আমি, আমরা রঙিন তাজমহলের অন্দরে রংধনুর সাতরংটে সারথি করে দিনাতিপাত করি; প্রচন্ড আবেগ, তীব্র আকাঙ্খার ভারে অনেক সময় নুয়ে পড়ে সত্যের কিছু খুঁটি, জীবনের কিছু ভিত্তি। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে তেমন কোন সিকি-আধুলী জমা থাকেনা বলে যে কাউকেই জমিয়ে ফেলি সঞ্চয় উপত্যকায়, হৃদ-গহীনে।

সময় বয়ে যায়। ধীরে ধীরে ঊষার আলো আঁধারী, কুয়াশার ঝাপসা চাদর অনাবৃত করে আমাদের স্বপ্নের আলয়; কচুপাতার উপরে শরতের শিশির বিন্দু দেখে এতকাল মনে মনে যেখানে ভেবেছিলাম, এক হীরক খন্ড আমার আঙিনায়; সকালের সূর্যের তেজোদীপ্ত রশ্মি সে শিশিরবিন্দুর উপর পড়তে থাকলে এক সময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সে ভাবনার ‘হীরক’; অজ্ঞতার দুয়ারে যেন প্রথম আঘাত। মরিচীকার সাথে যেন অজান্তেই প্রথম প্রণয়!

বহতা নদীর মতো জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রতিটি অজ্ঞানতার উপর জানা বা জ্ঞানের প্রভাব পড়ে, অজ্ঞতার রঙিন ফানুস চুপসে যায় সতত সত্যের সাদাকালো স্পর্শে। প্রতিটা ভুলেই নিজেকে বোকা মনে হয়: পরক্ষণেই শপথ নিই, এ ভুল আর নয়, কখনো নয়। এ ভুল, ভুলভঙ্গ আর শপথ চলতে থাকে জীবন সায়াহ্নেও…বারংবার ভুলের দুয়ারে হানি আঘাত!

বেলা পার হতে লাগলো ক্ষিপ্রগতিতে। জীবন যৌবনে রূপ নিল: যে শিশু প্রজাপতির পাখা, ফড়িংয়ের লেজ বা ছোট বাছুরের লাফালাফিতে অপলক দৃষ্টিতে বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই পার করে দিতো ককত বেলা, যে কিশোর মাঠের হাতছানির জবাব দিতো সহৃদয় কোমল মন নিয়ে, তার মাথায় এখন জীবন সংসারের বোঝা। যেন একমুখী সম্মুখ গলিতে সম্মুখপানে ছুটেচলায় সে বাধ্য, বদ্ধপরিকর। মুখে পিছুটান বলে সত্য, আসলে তার গতিবেগ সম্মুখ সমরে, তীব্রতায়, কিংবা মন্থরে..

যেন কিছু একটা করতেই হবে: উচ্চশিক্ষা, ক্যারিয়ার, সংসার, সামাজিকতা, দায়িত্ব – শব্দগুলো যেন তার অন্তরের প্রতিবেশি, প্রতিধ্বনিও। লালিত হয় শতস্বপ্ন। প্রকৃতির রূপ ইন্দ্র-স্পর্শিত হয় সত্য, কিন্তু পূর্বেকার হৃদ্যতার সাক্ষাত কি আর হয় ! নদীর কলকল ধ্বনি, বটের ছায়ায় শ্রান্ত কৃষাণের বিশ্রাম, জেলের মাছ ধরার দৃশ্য, মাঠে সবুজের অপরূপ রূপ, বিকেলের ছায়ায় শরীরের দীর্ঘ রূপ ইত্যাদি আর তাকে টানে না; অনেকটা সুকান্তের চাঁদ-রুটি গোলকধাঁধা বা রবার্ট ফ্রস্টের ‘মাইলস টু গো বিফোর আইসস্লিপ’ এর মতো।

এ ছুটে চলার মাঝে আশে পাশের তেমন কিছুই তার দর্শনে পড়েনা, হৃদয় দিয়ে অনুভূত হয়না সেসব। চোখের দেখা তো আর আসল দেখা নয়, এ দেখায় কদাচিৎ হৃদের পরাজয়। “What’s life, if full of care? We have no time to stand and stare” এর আক্ষেপধ্বনির মতোই অদেখা ভুবনের মাঝে রোবটিক হাঁটায় বিকেল গড়িয়ে কখন যে গোধুলিলগ্ন চলে আসে, তা বুঝতেই পারেনা পথিক।

সাঁজের মায়া। বড়ো অদ্ভুদ মায়া। জীবন তখন অস্তমিতো সূর্যের জ্যোতিহীন আভার মতো, দন্তহীন সর্পের মতোই, যে সূর্য হারিয়েছে দুপুরের যৌবন, মধ্যাহ্নের তেজ ও শক্তি। Shakespeare এর ভাষায়,
‘……Last scene of all
That ends this strange eventful history.
Is second childishness and mere oblivion,
Sans teeth , sans eyes, sans taste, sans everything”.
(As You Like It)

চাইলে হাতরিয়ে আলো আঁধারির পথ মাড়িয়েও ছুটতে পারে সে পথিক, আর নয়তো এ খেলা এবার থামাতেও পারে।

কিন্তু বিধি বাম। এতোদিন পিছুটান আর সম্মুখটানে ছুটে চলা পথিক যাদের সাথে সন্ধ্যার বিশ্রাম কাটাবে বলে ভেবেছিলো সর্বক্ষণ, তারা সবাই কি তাকে সময় দিবে? উত্তরটা কঠিন, বেশ কঠিন। কারণ তাদের অনেকেই হয়তো এখন মধ্যাহ্নের দুর্গম, ব্যস্ত যাত্রায়: যেমনটি নিজের এতকাল ধরে পার করে আসা দুস্তর মরু, দুর্গম গিরি বা সর্পিল মেঠোপথ।

পরিবার স্বজনদের কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ। যাত্রাপথের সুদীর্ঘ কালে যেসব সারথি ছিল ছায়ার মতো, বহু আপন হয়ে, বহু।আপন সেঁজে, দু’জন দু’জনার হয়ে, এ বেলায় কোথায় আছেন তারা? নৈঃশব্দে থেকেও অনুধাবন করে, দেখেও কালে ভদ্রে। কেউ কেউ হঠাৎ দেখা হলে আগন্তুক সাজে! অবশ্য ইতোমধ্যে কেউ বা বরণ করেছে শাশ্বত মরণ যন্ত্রণা: অনেকে বেরসিক বার্ধক্যে: কেউ কেউ পরপারের ডাক আসার ভয়ে, কেউ কাঙ্খিত অপেক্ষায়, কেউ এখনো আগেই মতোই আছে- যেন কখনো যেতেই হবেনা চিরন্তন মৃত্যুপুরীতে!

সন্ধ্যালোকে পূর্বক্ষণে এ অনুধাবন যেন অপূরণীয়, অসমাধানযোগ্য: আপন ভেবে যাদের টানা হয়েছিলো কাছে, তাদের দূরে চলে যাওয়া যেমন মনোকষ্টের; তেমনি বিস্ময়ের হয়ে থাকে এতকাল অবজ্ঞায় দূরে সরিয়ে দেয়া সুজন-স্বজনদের হৃদ্যতা, আন্তরিকতা, সহমর্মিতা। যোগ-বিয়োগ, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিতে ভরে উঠা পথিকের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ তখন মুছে যায় প্রাপ্তির আনন্দে: বৈষয়িকতার নাগপাশে থাকা তার দিবস যেন নিষ্ফলাই ছিলো, ছিলোনা শুধু পার্থিব বা আর্থিক; বরং শুধু আত্মিক সংযোগই যেন পূর্ণ করেছিল তার স্বপ্নতরী..

শ্রম-সাধনা-সংকল্প-সংগ্রামের সংযোগে দীপ্ত পথিকের ছোট তরীও এখন পূর্ণ প্রাচুর্যে, যেন রবী ঠাকুরের
ভাষায়-
“ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছােট সে তরী
আমারি সােনার ধানে গিয়েছে ভরি’।
শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি’,

যাহা ছিল নিয়ে গেল সােনার তরী।”

—–
মোঃ নাজিম উদ্দিন
www.lekhokbangladesh.com
০৮ অক্টোবর ২০২০

লেখাটি লিখেছেন