মেজবানঃ কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

Feb 26, 2021 | ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-রাজনীতি | 0 comments

মেজবানঃ কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

——-

‘মেজ্জান দিইয়্যি, মেজ্জান দিইয়্যি, ইতেরত, ইতেরত’… চট্টগ্রামের এক শিল্পীর মুখে গানটা যখন প্রথম শুনলাম, তখন সে গানের কথাগুলোর মাধ্যমে মেজবানের প্রকৃত চিত্র কিছুটা উঠে এসেছে। গ্রাম বাংলা, বিশেষত চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘মেজবান’ এর কথা দেশ ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে পৌঁছেছে।

মেজবান কেন হয়? বিভিন্ন উপলক্ষেই মেজবানের আয়োজন করা হয়। বিশেষত যে বিষয়টা মনে রাখার মতো সেটি হলো, মেজবানে ভ্রাতৃত্বের বাঁধন সুদৃঢ় হয়, হয় প্রতিবেশির সাথে সৌহাদ্য, বাড়ে আত্মীয়দের সাথে হৃদ্যতা। সমাজের সবাই ও আত্মীয় স্বজনের এক মিলনমেলা যেন!

মেজবানের বিশেষত্ব হলো, একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে রান্না করে বড় পাত্র (ডেক) দ্বারা রান্না সম্পাদন এবং তা একই সমতায় পরিবেশন। সুস্বাদু এ মেজবানি মাংসের সাথে থাকে মেজবানি ডাল, নলার ঝোল ইত্যাদি।

ছোটবেলায় মেজবানে যেতাম খুব বেশি; অবশ্য তখন এ যুগের মতো মেজবান দেয়ার সামর্থও যেমন অনেকের ছিলোনা, তেমনি আজকের ব্যস্ততাও ছিলো অনুপস্থিত। তখন মেজবানে দুভাবে খাবার পরিবেশন করা হতো: ছোটদের পাটি বা চট বিছিয়ে, উঠানে। বড়দের চেয়ারে বসিয়ে। ছোটবেলায় যখন পাটিতে বসিয়ে খাবার দেয়া হতো, তখন খুব তাড়াতাড়ি বড় হওয়ার ইচ্ছা হতো: বড় হলে চেয়ারে বসে খেতে পারবো!

মেজবানে স্বেচ্ছাসেবিগণ ছিল খুব চালাক। দাওয়াত না পেয়েও যারা খেতে আসতো, তাদের ধরিয়ে দিতো দাওয়াতকারীর কাছে। তার চেয়েও বেশি লক্ষণীয় ছিলো, পলিথিন বা পাত্র করে খাবার নিয়ে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবিদের চোখ এড়াতো না!  দু’বার খেয়েছে কি না তা কারো উপর সন্দেহ হলে কেউ কেউ হাত দেখেও নিশ্চিত হতে চাইতো!  কী মুসিবত!

পাত্র হিসেবে মাটির বাসন/ প্লেট ব্যবহার হতো বেশি; চট্টগ্রামের ভাষায় যেটা ‘সোয়ালি’। নলা পাওয়ার জন্য সুপারিশ থাকতো সিনিয়র বা ভিআইপি মেহমানদের। তবে আয়োজকের অজ্ঞাতসারে স্বেচ্ছাসেবিরা অনেক সময় কিছু হতদরিদ্র বা দাওয়াত না পাওয়া (“আবোলাইন্ন্যা) মানুষকে তাড়িয়ে দিতে দেখা যায়, যা দুঃখজনক। মেজবানে একটা কথা “আবোলাইন্ন্যারা” ধরে নেয়-! “আয়োজক হুঁশ করে না বললেও, আমরা আক্কল করে চলে আমবো”। তবে কিছু লোক আবার খেয়েই কান্ত হন ননা, বাসায় নেয়ার জন্যও পিড়াপিড়ি করেন, যা সত্যিই লজ্জাজনক। কেউ কেউ খাওয়া শেষ করে যাওয়ার সময় খাবার বা আয়োজকের বদনামি করতে করতে যেতে দেখা যায়, যা গর্হিত, নিন্দনীয়।

মেজবানের মাধ্যমে সবাই একসাথে খাওয়ার সুযোগ হয়, দেখা হয় অনেকের সাথে, বাড়ে বন্ধনের সুদৃঢ়তা। তবে কিছু কিছু মেজবানে অতিরিক্ত আয়োজন, আবার কিছু জায়গায় খেতে গিয়ে অনেকে অপচয় করেন, যা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়।

আজ তেমনি এক মেজবানে গ্রামে উপস্থিত থেকে নিজের বিগত দিনের সময় রোমান্থন করার সুযোগ হয়েছে। সাক্ষাত করার সুযোগ পেয়েছি অনেক প্রতিবেশি, স্বজনের সাথে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান চালু থাকুক, শেকড়ের গাঁথুনির মতো, হৃদ্যতার সিড়ির মতোই।


মোঃ নাজিম উদ্দিন
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

লেখাটি লিখেছেন