বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক ভাবনা

Jun 4, 2021 | ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-রাজনীতি | 0 comments

Post View : 1
 

বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক ভাবনা।
শাহিদা আকতার জাহান।

একটা দেশ, একটি জাতি লাল- সবুজের সতন্ত্র পতাকা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু এক অভিন্ন স্বাত্তা। সকল অর্থেই তিনিই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলাদেশ।

আধুনিক যুগে যে ক’জন মহান বীর নেতা তাদের নিখুঁত জ্ঞান-মেধা ও সুনিপুণ চিন্তা-ভাবনায় বাঙালী জাতিকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার, এগিয়ে যাবার নিরবিচ্ছিন্ন প্রেরণা জুগিয়েছেন। তাদের মধ্যে সবার শীর্ষে অবস্থান করছেন সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন বুননের কারিগর। জম্নলগ্ন থেকে জীবনের সব সোনালী দিনগুলো জেলে কাটিয়ে, বাঙালির সুখ- দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, স্বপ্ন, সাহস নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন লালন করেছেন চিরদুঃখী বাঙালির স্বপ্নে। তিনিই ছিলেন বাঙালির স্বাধীনতার শেষ ভরসা। তিনি শুধু একটি স্বাধীন দেশ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি। জাতি গঠনে ও রেখে গেছেন অন্যান্য দৃষ্টান্ত অবদান। একটি শক্তিশালী, সমৃদ্ধশালী আধুনিক অর্থনৈতিক দর্শন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অনেক পূর্ব থেকেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতির সাথে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক তার নিজের ধ্যান-ধারণা ও তার বক্তব্য স্পষ্ট করে তুলেছিলেন, বিবৃতি, প্রচার ও পুস্তিকাতে স্থান পায় অর্থনীতি। পঞ্চাশ ষাটের দশকে আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক কর্মসূচি যথা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিলো।

ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচিতে তিনি এই বৈষম্যের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি কৃষি, শিল্প, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, বৈদেশিক বাণিজ্য, রাজস্ব পদ্ধতি,ইত্যাদি ইস্যুতে অবস্থান সুস্পষ্ট হতে থাকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর শুরু হয় এসবের বাস্তব প্রয়ােগ। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মুখবন্ধে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং প্লানিং কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে প্লানিং কমিশন পুনর্গঠন ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন। স্বাধীনতার মাত্র দেড় বছরের মধ্যে প্রণীত এই পরিকল্পনাকে তিনি প্রস্তুতের সময়ের ছক থেকে ব্যতিক্রম বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “কোনাে পরিকল্পনাই, এমনকি সবচেয়ে সুন্দরভাবে গ্রথিত পরিকল্পনাও কোনাে ভালাে ফল অর্জন করতে পারে না- যদি না জনসাধরণের সার্বিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হয়। যদি না তারা কঠোর পরিশ্রম ও আত্নত্যাগের উদ্বুদ্ধ হয়”।প্রেক্ষাপটে তিনি জনসাধারণের প্রতি জাতি গঠনে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আত্ননিয়োগের আবেদন জানান।
উল্লেখ্য, কমিটিতে যেসব সদস্য অন্তর্ভুক্ত হলেন তারা হলেন ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রফেসর নূরুল ইসলাম, সদস্যবর্গ প্রফেসর মুশারফ হােসেন প্রফেসার রেহমান সােবহান ও প্রফেসর আনিসুর রহমান। বঙ্গবন্ধু সরকার ঐ অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, ঢালাওভাবে জাতীয়করণ প্রভৃতি বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করেন। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শুরুতেই তিনি বাংলাদেশকে উত্তরাধিকার সূত্রে দরিদ্র, একমুখী অর্থনীতি অনুন্নত অবকাঠামো, স্থবির কৃষি-পদ্ধতি এবং দ্রুত জনবৃদ্ধির একটি দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় দেশটির ভৌত অবকাঠামাে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে, সাংগঠনিক ও ব্যবস্থাপনা-পদ্ধতি ভেঙে পড়েছে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক অবলুপ্ত হয়েছে। বিগত দেড় বছরে দেশটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে জেগে ওঠার চেষ্টা করেছেন। দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। দেশের ভেতরে ও বাইরে বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে তখন খাদ্য শস্যের ভয়াবহ সঙ্কট চলছিলো। ওই সময়টায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যের সঙ্কটের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জও বঙ্গবন্ধুর সরকারকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। আর এগুলো মোকাবিলার জন্য যুদ্ধ-বিধধস্ত দেশে তাঁর হাতে সম্পদ ছিলো খুব সীমিত। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বৈরি অবস্থান করেন। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু এই অল্প সময়ে দেশজ সম্পদ এবং কিছু আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়েই ধ্বংসস্তুপ থেকে দেশের অর্থনীতিকে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তাই তিনি দীপ্তকন্ঠে বলেন,” আমি বিশ্বাস করি যে জনগণ, আমার দল ও আমাকে যে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছে, তাই নিয়ে আমরা আমাদের অসংখ্য সমস্যা কাটিয়ে শোষণমুক্ত একটি সমাজ গঠনের ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম হবো- যে সমাজের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন বিসর্জন দিয়েছে এবং আরো অসংখ্য লোক অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার ভোগ করেছে”।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি পরিচয় বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য তা হলো তিনি ছিলেন বাঙালি জাতি মুক্তির দিশারি।হাত বাড়ালেই তিনি ধরে ফেলতেন পারতেন বাঙালির মনের আশা, বাঙালির ভাষা, বাঙালির সুখ-দুঃখ চাওয়া পাওয়া। জীবনের সমস্ত দিনগুলো জেলে কাটিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এক বিরাট স্বপ্ন-কী করে পরাধীন বাঙালিকে স্বাধীন করা যায়।১,৪৭,৬১০ কিলোমিটারে প্রায় ১৭ কোটি বাঙালির মনে, রক্তের শিরায় উপশিরায় মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী নাম। তিনি বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন কিভাবে অান্দোলন সংগ্রাম যুদ্ধ করে নিজেদের অধিকার অাদায় করতে হয় স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয়, কিভাবে অর্জন করতে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নির্যাতন-নিষ্পেষণ হতে মুক্ত করে তিনি বাঙালী জাতিকে শুধু একটা দেশই উপহার দিয়েছেন তা নয়। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি বিধ্বস্ত, ভঙ্গুর দেশকে একটি যুগোপযোগী অর্থনীতির রূপরেখা দাঁড় করিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভাব ঘটে বাংলাদেশের। পরবর্তীতে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হন বঙ্গবন্ধু এবং লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পা রাখেন তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন ভূমি বাংলাদেশে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের প্রাণ, দুই লক্ষধীক মা-বোনের সম্ভ্রম এবং অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের কষ্টের, হারানোর বেদনা কখনো ভোলার নয়। এই শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করেছেন। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী অবিনাশী নাম। তিনি মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করে এগিয়ে গেছেন অবিচল চিত্তে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা,ভোটের ভাতের অধিকার প্রতিষ্টিত করা।অাইনের শাসন কায়েম করা। বৈষম্যের হাত থেকে দেশকে রক্ষা এবং অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে রক্তে ভেজা সংবিধানেই স্থান দিয়েছেন অভাব দারিদ্র্যাতার মুক্তির পথের নির্দেশনা। বৈষম্য তাড়াতে জনগণের কাছে ব্যক্ত করেছেন দৃঢ় প্রতিশ্রুতি। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ছিলেন নির্ভীক এক সাহসি সৈনিক। আত্মনির্ভরশীল হওয়া ছিলো তার নেতৃত্বের মূল প্রতিধ্বনি। বাঙালি জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন, দারিদ্র্যমুক্ত ও বৈষম্য হ্রাস, শিক্ষিত সমাজ ও সোনার বাংলা গড়াই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রধান লক্ষ্য।

গরিব-দুঃখীসহ সর্বস্তরে মানুষের মৌলিক চাহিদা, অন্ন-বস্ত্র বাসস্হান, শিক্ষ চিকিৎসা পূরণের মাধ্যমে দেশের মানুষ উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্র্যাতা থেকে মুক্তি পাবে। তিনি সবসময় স্বপ্ন দেখতেন, ভাবতেন, বলতেন, এ স্বাধীনতার স্বাদ এই স্বাধীনতার সুফল আমরা গ্রহণ করতে পারব না, যদি না আমরা অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে ব্যর্থ হই। তাঁর জীবন যৌবন নানা কষ্টের ঘটনাবহুল জীবন। তাঁর রাষ্ট্র, দেশ সমাজ ও দর্শণপাঠ করলে দেখা যায় তিনি তাঁর প্রিয় বাংলাদেশের উন্নয়ন, বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মাথাউচু করে স্হান করার জন্য রাতদিন চিন্তা করতে, ভাবতেন। কি করলে দেশ উন্নত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে। তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জুড়েই ছিল বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা। বঙ্গবন্ধু এই ভয়াবহ বৈষম্যমূলক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে এ দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন দীর্ঘমেয়াদি অর্থনীতি মুক্তির প্রবর্তক। পরনির্ভরশীলতা ত্যাগ করে নিজস্ব সম্পদের ওপরে দেশকে শক্ত করে দাঁড় করানো ছিলো বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক মূল অার্দশ ও লক্ষ। সেই লক্ষ্যে তিনি তরুণ সমাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নিয়ে তরুণ সমাজের মাঝে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টিভি ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোন অগণতান্ত্রিক কথা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি নতুন ব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরনো সমাজ ব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ব।’ স্বাধীতা পরবর্তী যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ ছিল ভঙ্গুর।তখন ছিল না পর্যাপ্ত অর্থ, অবকাঠামো, দক্ষ জনশক্তি, রফতানি আয় কিংবা শিল্পকারখানা। তখন বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল দুর্যোগপূর্ণ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুর দেশ হিসেবে। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার উপহাস করে বলেছিলেন-বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন কৃষকরাই স্বাধীন সোনার বাংলা গড়ার মূল কারিগর। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বেতার টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বঙ্গবন্ধু কৃষকের কথা বলেন, ‘আমাদের চাষিরা সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন না ঘটলে এ জাতির ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়’। কেমন বাংলাদেশ চাই’ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টিভি ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোন অগণতান্ত্রিক কথা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুবদ্ধ। একটি নতুন ব্যবস্থার ভীত রচনার জন্য পুরাতন সমাজব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়বো। ১৯৭২ সালে আমাদের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যুদ্ধবিধ্বস্ত দশ তখন আমাদের রিজার্ভে কোন বৈদেশিক মুদ্রাও ছিল না। শতকরা আশি ভাগের মতো মানুষ দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, “জনগণ যাতে জাতি গঠনেমূলক কাজ শুরু করতে পারে, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষার একটি কাঠামোর আবশ্যকতা সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ সচেতন। পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুরতায় নির্যাতিত ও তাদের স্থানীয় দালালদের মধ্যে এই মুহূর্তে তিক্ততা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। এতদসত্ত্বেও তারা যে সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে, তা খুবই প্রশংসনীয়। আমি আমাদের জনগণকে আশ্বাস দিচ্ছে যে, নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তি ও তাদের দালালদের শাস্তি দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মৌলিক মানবিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। দুষ্কৃতকারীদের আইন মোতাবেক যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। আইন তার নিজস্ব গতিধারায় চলবে। কাজেই আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধৈর্য ধারনের আবেদন জানাচ্ছি।

বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ছিলো এদেশের গণমানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক গভীর মানবিক সংগ্রামী দর্শন। তার এ দর্শনের ভিত্তিমূলে ছিলো জনগণের ঐতিহাসিক বিশ্বাস অার ভালোবাসা। যা কেবল জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন অনুযায়ী, গণমানুষের মুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত মুক্তি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে জন্ম হলো ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশের, যেখানে সাংবিধানিকভাবেই প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। তিনি সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন, দুর্নীতি-শোষণ, বঞ্চনা-দুর্দশামুক্ত বাংলাদেশের গড়ার দৃঢ় প্রত্যায় ব্যক্ত করেন। কৃষি খাতে গবেষণার জন্য গড়ে তুলেছেন কৃষি গবেষণা কেন্দ্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৭৩ সালে বিধ্বস্ত হওয়া কৃষি খাতকে নবযৌবন দান করেন।
পাকিস্তানি শাসনকালের ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি ও তাদের সব ঋণ সুদসহ মাফ করে দিয়ে নিজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

জাতির পিতার সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন ছিলো ইচ্ছা ছিল দেশকে আত্মনির্ভরশীল ও উন্নত দেশে পরিণত করা। ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল করা। তাই বঙ্গবন্ধু শুধু একটা নামই নয়, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে স্বাবলম্বী করার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন। শুধু কৃষি শিল্প-বাণিজ্য নয়; বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল গ্রাম উন্নয়ন, কৃষির উন্নয়ন,শিল্প উন্নয়ন। দুঃখি -মেহনতী মানুষের আয় ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস ইত্যাদ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের শেষ ভরসা উজ্জীবিত তরুণ নেতা, ছিলেন চৌকস ক্যারিশমা নেতৃত্বের অধিকারী। গ্রাম উন্নয়নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর সরকার শিল্পক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধনের লক্ষ্যে বড় বড় শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, বীমা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের একাংশ জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে আসে। কিন্তু পরিচালনাগত অদক্ষতা ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সে পদক্ষেপ তেমন সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া তখন সম্ভব হয়নি। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড- এ দর্শনের আলোকে বঙ্গবন্ধু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, বিজ্ঞানসম্মত, মানসম্মত ও বাস্তবমুখী করার লক্ষ্যে দেশের নামকরা বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই খুদার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ১৯ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।’ জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে চার ভাগ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয় হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করতেন।

বস্তুত, বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে ছিল শিক্ষার প্রতি অসামান্য ভালবাসা ও অনুরাগ। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনার ব্যাপ্তি ছিল সর্বত্র এবং তা ছিল সর্বজনীন, কালজয়ী। আমৃত্যু তিনি যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বুকে ধারণ করেছিলেন সেই অপূর্ণ স্বপ্ন হৃদয়ে আঁকড়ে ধরেছিলেন সোনার বাংলাকে।, তাঁর সে স্বপ্ন আজ আর কল্পনা নয়, নয় কোন অলীক স্বপ্ন বাসনা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে বাস্তবে রূপ লাভ করে দূবারগতিতে সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তার দেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন। এবং তা বাস্তবতায় করে গেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার লড়াই ছিল আপোসহীন। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বখ্যাত আইনজীবী সন ম্যাকব্রাইড বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা শুধু পতাকা পরিবর্তন ও দেশের নতুন নামকরণ বোঝায় না, তাঁর দৃষ্টিতে স্বাধীনতার অর্থ হলো সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও নীতিবোধসম্পন্ন আদর্শবাদ।’ তাঁর সকল কর্মকাণ্ডের মূলে ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ওধর্মনিরপেক্ষতা। আমৃত্যু তিনি এই আদর্শগুলো হতে একটু ও বিচ্যুত হননি। দক্ষভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিনি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ও সম্পদকে প্রত্যন্ত এলাকায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা যেখানে স্থানীয় উন্নয়নের কাজ স্বতন্ত্রভাবে চালু থাকবে। সেখানে উন্নয়নের মূল একক হবে গ্রাম।

জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত গ্রাম সরকার স্থানীয়ভাবে কর সংগ্রহ করতে পারবে। স্থানীয় এ কর্তৃপক্ষের প্রধান কাজ হবে- গ্রামীণ জনশক্তির ব্যবহার।ভূমি সংস্কার কর্মসূচী, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীর বাস্তবায়ন এবং গ্রামীণ কৃষি শিল্পের প্রসার। মোটকথা, বঙ্গবন্ধু প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের এবং গ্রাম সরকারের সঙ্গে শহরের ব্যবধান কমিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। আজকে আমরা যে সুখী- সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে দেখছি, দেশের আনাচে কানাচে যে উন্নয়নের জোয়ার দেখছি, পিচঢালা রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ-মসজিদ মাদ্রাসা মন্দির বিহার -বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিক্য দেখছি, দেখছি মেট্রোরেল কিংবা পদ্মা সেতুর দৃশ্যমানের বাস্তবতা- সেসবগুলো স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন বাঙালির আরাধ্য কালজয়ী মহনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালীর গর্বিত সন্তান। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দারিদ্র্য দূরিকরণের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যান সফলতার সাথে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় আমূল সংস্কার, শিল্প বিকাশে নয়া উদ্যোগ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্রদান, কৃষির আধুনিকায়নে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ, সমবায় চেতনা বিকাশে শুরু করেছিলেন কর্মযজ্ঞ। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানুষের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়া, মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, নারীদের স্বলম্বি করার লক্ষ্যে নারী জাগরণ কর্মসূচি ছড়িয়ে দিতে সবসময় বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় ছিলো। পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় আনতে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। উন্নয়ন ভাবনায় দর্শন বরাবরই প্রভাব বিস্তার করে। আর সেখানেই পরিস্ফুটিত হয় ভবিষ্যৎ বিকাশের স্বপ্ন। ‘

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান সরকার কর্তৃক প্রণীত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ সফল না হওয়ার পেছনে যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলাে হচেছ প্রশাসনযন্ত্রে দুর্নীতি, কায়েমী স্বার্থবাদী গােষ্ঠীর চক্রান্ত এবং আন্তর্জাতিক চক্র যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে এ জাতীয় একটি স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রযন্ত্রকে একটি বাধা হিসেবে দেখছিল।

পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে গিয়েই ১৫ অাগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন।নিহত হওয়ার পর স্বাধীনতা বিরোধীচক্র মিলে একটি অগণতান্ত্রিক উপায়ে অবৈধ সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়।

শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যসহ গ্রামীণ সেবা-কাঠামাে গড়ে উঠবে এবং বিশেষ করে জন্মনিয়ন্ত্রণের ওপরেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য বলেও বঙ্গবন্ধুর গভীর বিশ্বাস ছিল কৃষকসমাজ তথা গ্রামীণ অবকাঠামাে উন্নয়নের পাশাপাশি শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী ভূমিকায়ও বিশ্বাসী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তােলার লক্ষ্যে তিনি ঘােষণা করেছিলেন শ্রমিক কর্মচারীদের যথাযথ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা :
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি পুরােপুরিভাবে গড়ে তােলার কাজে শ্রমজীবীদেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয় । এই নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমে শ্রমিকদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হলে তাদের বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হয়। তখন আর পুঁজিপতি প্রভুদের ভােগের জন্য সম্পদ উৎপাদন করা চলে না। তখন যা উৎপাদন হয় তা শ্রমিক- কৃষক এবং বাংলাদেশের সব মানুষের কল্যাণের জন্য।

সমাজতন্ত্রের শত্রুরা এই লক্ষ্য অর্জনে বাধা এবং জাতীয়করণ কর্মসূচির সাফল্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে চায়। তিনি আরও বলেছিলেন যে, শ্রমিকরা সরকারের সঙ্গে একযােগে কাজ করে। সমাজতন্ত্রের শত্রুদের ধ্বংস করতে পারেন। কিন্তু এটা করতে হলে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রমিকদের ভূমিকা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণে আমূল পরিবর্তন আনার কথা বলেন। শিল্পোন্দানের সুফল সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষীদের ভােগ করতে দেওয়া প্রয়ােজন। সুতরাং জাতীয় স্বার্থের প্রতিকূল দাবি-দাওয়া পেশের মনােভাব ত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক শৃংখলা এনে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করা প্রয়ােজন বলে বঙ্গবন্ধু মনে করতেন।

——-

[লেখকঃ শাহিদা আকতার জাহান
সদস্য, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম।
নির্বাহী সদস্য, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগ।
সিনিয়র সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামীলীগ।
সভাপতি, চট্টগ্রাম দুঃস্থ কল্যাণ সংস্থা এবং
“বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা ও বিশ্বভাবনা” এবং “অপ্রতিরোধ্য শেখ হাসিনা” গ্রন্থদ্বয়ের রচয়িতা।

পুনশ্চঃ লেখকের তথ্য ও লেখনশৈলী অপরিবর্তিত রেখেই প্রকাশিত হয়েছে]