চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাঃ যেন হারিয়ে না যায়

Mar 15, 2021 | ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-রাজনীতি | 0 comments

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাঃ যেন হারিয়ে না যায়।      
—   মোঃ নাজিম উদ্দিন।


হেমন্তকালে নবান্নের উৎসব সারা দেশে; শীতের মিষ্টি রোদের উপভোগ্য দৃশ্য আর ভাঁপা পিঠার কথা মনে পড়ার কথা; মনে পড়ার কথা রোদ পোহানো (গায়ে রোদ লাগানো)।  সকাল কিংবা কনকনে শীতেও কাওআলী গানের আসরে আগুনের কুন্ডল জ্বালিয়ে নির্ঘুম রাতের কথা।

আরো কত নন্দিত পদ্ধতি, খেলাধুলা আজ চোখে পড়েনা! বলছিলাম আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগেও যে চট্টগ্রাম ছিল- সে সময়কার কথা; সে সময় অন্য সমস্যা তেমন ছিলনা, তাছাড়া, বিদ্যুত বা প্রযুক্তির এত উন্নত ছোঁয়া লাগেনি আমাদের গ্রাম গুলোতে; পৌষ বা মাঘ মাসের মধ্যেই ধান বা শস্য কাটা শেষ হলে সম্পূর্ণ বসন্তও গ্রীষ্মকাল ছিল চট্টগ্রামের ‘গ্রামের’ বালক-যুবার বিল-পাথারে হেসে খেলে বেড়ানোর দিন-রাত; আজ ইরি বা অন্য দু-তিন ফসলা মাঠ যা আগে দেখেনি; চলতো জ্যৈষ্ঠ মাসের বৃষ্টিপাতের আগ পর্যন্ত। হ্যাঁ, অবাক লাগবে অনেকের কাছে; ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউবের এ যুগে সুবিশাল মাঠে দিনের আলো বা চাঁদের সন্ধ্যায় খেলাধুলার যে রঙিন দিনগুলো ছিল; কিংবা বৃষ্টিবৃঘ্নিত ‘ইনডোর গেইম’ যেমন ‘বাঘ পাইর, বা ‘মোগল পাঠান- তা আজকের অনুর্ধ্ব ২০ বছর বয়সী অনেকের কাছে কল্পলোক যে!

অতি আধুনিক, তথা অতি প্রযুক্তি-নির্ভর এ যুগের তেমন কতগুলো লোকজ খেলাধুলার কথা মনে পড়ে যায়- যেগুলো শিশু-কিশোর-যুবার শারিরীক-মানসিক-মূল্যবোধ সংশ্লিষ্ট উন্নতিরও সহায়ক ছিল অনেকাংশে; ছিল প্রতিযোগিতার মাঝেও সম্প্রীতি, চ্যালেঞ্জের মাঝেও ভ্রাতৃত্ববোধের অকৃত্রিম শিক্ষা। রুচির বিবর্তন, খোলামাঠের অভাব বা ক্রমহ্রাসমান গ্রামীণ ঐতিহ্যের এ সন্ধিক্ষণে এসেও যেসব সুপরিচিত খেলাধুলার মাঝে ফিরে যাওয়া যায় স্বর্ণালী অতীত, তার কয়েকটার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া যেতে পারে; যাদের মধ্যে কিছু আছে ‘আউটডোর প্রকৃতির’ আর অন্য কয়েকটাকে ‘ইন ডোর’ বলা যেতে পারে।

ফঅর খেলাঃ গ্রাম বাংলার দাঁড়িয়া বান্ধা খেলা ‘ফঅর খেলা’ বা ‘পর খেলা’ নামে সুপরিচিত ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এ খেলায় একটি ছক থাকে খেলোয়াড়দের দৌড়ের জন্য যাকে বলা হয় ‘পর খেলার দাইর’; প্রতি দু’জন খেলোয়াড়ের জন্য একটি করে দাইরের প্রয়োজন হয়। অবশ্য মহল্লা যে দাইরে থাকে সে দাইরে একজন ছাব থাকে ( ছাব অর্থ সহচর বা একই দলের অনুসারী)। সমান্তরাল একটি রেখার তিনটি গর্ত থাকে। প্রতি দুই দাইরে দু’কামরা হয়। অগভীর এ গর্ত গুলোকে ‘ফোত্তা’ বলা হয়। কমপক্ষে দুই জোড়া খেলোয়াড় লাগে পরখেলা খেলার জন্য। প্রতি দলে এক জন মহল্ল্যা হয়। তারা একজন অন্য দলের মহল্ল্যাকে বলে  এই দল ‘উড়ে’ বা আক্রমণকারী হবে, অপর দলকে ধরে বলে অর্থাৎ খেলার ছক রক্ষা করবে। তখন একজন উড়ে দল নিয়ে উড়তে যায় এবং ধরতে দল প্রত্যেক দাইরে গিয়ে দাঁড়ায় নিজের ছক রক্ষার জন্য। উড়ে দল প্রথম দাইরে এসে সমবেত হয়। সেখানে ধরে বা আত্বরক্ষার দলের মহল্ল্যা এসে ‘পর’ বলে ডাক দিলে উড়ে দল মহল্যা ছুঁয়ে ফেলতে না পারে মত ছকে ঢুকে তখন মহল্ল্যা দু’পাশে ও মধ্যের দাইরে দৌড়াদৌরি করে উড়ে দলের কাউকে ছুঁয়ে ফেলতে পারলে উড়ে দল পরাজিত হয়ে যায়। তখন তাদের ধরতে হয়।

অন্যদিকে উড়ে দলের সাআব বা অনুসারীরা ধরে দলের প্রতি দাইরের সাআবকে ফাঁকি দিয়ে মহল্ল্যার শেষ দাইর বা সীমানা পার হয়ে যেতে পারলে তখন শেষ দাইর প্রথম দাইর হয়। উল্টো দিক থেকে খেলার দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হয়। আর উড়ে দলের একজনও যদি কেউ না ছোঁয় মত শেষ দাইর পাড় হয়ে যেতে পারে, তবে তাদের জয় হয়। এভাবে দাইর রক্ষা কারীর ও আক্রমণকারীর মধ্যকার ক্রমাগত প্রতিযোগিতা ও সুতীক্ষ্ম দৃষ্টি এবং সতর্ক দৌড়ের মাঝে খেলার পরিসমাপ্তি হয়।

ডাঙ-গোলা খেলাঃ
ডাঙ-গোলা দু’জন খেলোয়াড় নিয়েও খেলা যায়। হাতের মুঠোয় ধরা যায় এমন দু’ফুট লম্বা বাঁশ বা গাছের ডালের খন্ডকে ডাঙ ও ৯/১০ ইঞ্চি লম্বা হাতের আঙুলের সমান মোটা গাছ বা বাঁশের ডালকে গোলা বলা হয়। সমান সংখ্যক দু’দলের মধ্যে ডাঙ-গোলা খেলা অনুষ্ঠিত হয়। একদল উড়ে আর অন্য দল ধরে। নির্দিষ্ট জায়গায় একটি ছোট গর্ত থাকে। উড়ে দলের একজন করে ধরে দলের দিকে গোলা ছুঁড়ে মারে। গোলা মাটিতে পড়ার আগে ধরে ফেলতে পারলে উড়ে দল মারা যায় (যেরে যায়); তখন তাদের ধরতে যেতে হয়। আর গোলা মাটিতে পড়লে তা ধরে দলের একজন ডাং এর দিকে ছুঁড়ে মারে। গোলা ডাং এ ঠেকলে উড়ে দল মারা পড়ে; যদি না ঠেকে তখন উড়ে নদল ডাং দিয়ে গোলা পেটাতে থাকে, গোলার দুরত্ব হিসাব করে মোহর গোনা হয়। অপর নিয়মে গোলার দূরত্ব ডাং দিয়ে ও এঁরি, দুঁরি, তেঁরি, চুঁরি, চাম্বা, জেক, ডান বলে এক এক মোহর গণনা করা হয়। বিশ মোহরে হয় এক ‘ললে’।

ঘাডুডু খেলাঃ শহরে হাডুডু খেলার সাথে মিল থাকা এ খেলা গ্রামীণ চাট্গায় খুব জনপ্রিয় ছিল ঘাভুডু নামে। এ খেলার একটি বোল থেকে তা জানা যায়। যেমন-
ঘাডুডু লক্ষণ, তোরে মাইরত্যে কতক্ষণ—
তোরে মাইরত্যে দেরি,
ছটপট ছেরি…………….

সমান সংখ্যক খেলোয়াড়ে দু’দলে ভাগ হয়ে মাঠের দু’দিকে যায। আর মাঝখানে টানা হয় সীমারেখা। পর্যয়ক্রমে প্রতি দলের একজন করে খেলোয়াড় সীমারেখা থেকে দম (নিঃশ্বাস) বন্ধ না করে বোল ( উপরে বর্ণিত বোল বা ছড়ার মত) নিয়ে প্রতিপক্ষের এলাকায় ঢুকে কাউকে ছুঁয়ে আসতে পারলে সে মারা যায় (হেরে বাদ যায় বা অযোগ্য বিবেচিত হয়)। আর বোলওয়ালাকে ধরে রাখতে পারলে বা প্রতিপক্ষের সীমানায় থাকা অবস্থায় দম পড়ে গেলে সেও মারা যায় ধরে নেয়া হয়। এভাবে দু’দলের পর্যায়ক্রমে মরা বা ধরার শেষে যে দলের জয় হয়; অন্যথায় হেরে যায়। এ খেলা আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
এছাড়াও উল্লেখ্য ছিল সে সময়ের প্রসিদ্ধ বলি খেলা, এচকি মেচকি খেরা, গরুর লড়াই, তুম্বরু খেলা, চিছি খেলা, টুবি খেলা (পুকুরে), সাত ছে’রা খেলা, কুলুক খেলা (লুকোচুরির মত), জোড় না বেজোড় খেলা, পানি খেলা ( যা নৌকা বাইচ নামেও পরিচিত), ঢেঁকি খেলা, দরি খেলা, কড়ি খেলা, কইল্যা খেলা, কৈতর (কবুতর) বাচা খেলা ইত্যাদি। এ খেলা সমূহ মাঠে, বিল বা বাড়ির আঙিনায় খেলা হত। এগুলো যেমন গ্রামের অনেক বাড়ির ছেলে মেয়েদের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করতো, করতো শারিরীক সক্ষমতা সৃষ্টি, আনতো নিয়মানুবর্তিতা, মানসিক তীক্ষ্মতা; আর অন্যদিকে রোধ করত অসামাজিক কার্যকলাপ, বৃদ্ধি করতো শৃঙ্খলাবোধ, বিনয়, নেতৃত্ব আর টিমওয়ার্ক- যা আজকের সমাজে অধিক প্রয়োজন।

তখনকার সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৃষ্টি কিংবা বাইরে না পাঠাতে বড়দের নিষেধাজ্ঞা থাকলে বেশ কিছু খেলা ছিল যা তারা ঘরের ভিতরে ঢেউরি ঘরে বা উঠোনে খেলতে পারতো; তার মধ্যে উল্লেখ্যযেগ্য ছিল-বাঘ-পাইর, মোগল-পাঠান এবং হাত গুত্তি খেলা। বাঘ- পাইর খেলাটির নাম সম্ভবত বাঘ ও পাইক (পদাতিক সৈন্য) খেলা। খেলাটি ২ টি বাঘ ও বিশটি গুটিরূপ পাইকের মধ্যকার যুদ্ধ। গুটি দ্বারা বাঘ বন্দি হয় বা বাঘ গুটি খেয়ে ফেলে। চালের উপর চালের দক্ষতা দিয়ে বাঘ চায় গুটি একটার পর একটা শেষ করতে আর পাইর বা গুটি চায় চতুর্দিকে ব্যূহ সৃষ্টি করে বাঘকে বন্দি করতে। আর বুদ্ধি ও সুকৌশলের জোরে কোন এক পক্ষ জয়ী হয়। এ খেলা মেধা, সৃজনশীলতা ও বুদ্ধি দীপ্ত কৌশল বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। মোগল পাঠানও তেমন একটি ‘ইনডোর’ কৌশলী খেলা- যা মূলত পেল শতকে বাংলার অধিকার নিয়ে মোগল ও পাঠান শক্তিদ্বয়ের মধ্যে যে যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল সম্ভবত তারই স্মরণরূপে প্রচলন হয়েছিল। অধিকজার নিয়ে দু’শক্তির এ যুদ্ধে ছক করা ঘরে দু’পাশে ১৬ টি ঘরে ৩২ টি গটিরূপ সৈন্য সমাবেশ করে। এক পক্ষ অপর পক্ষকে লাফ দেবার সুযোগ দিয়ে চাল দ্বারা অপরের অঞ্চল দখল করতে চায় সৈন্য মারার মাধ্যমে। আর দখল করেই জয়লাভ করে প্রতিকী এ যুদ্ধ। এ যুদ্ধও সাময়িক কসরত ও বুদ্ধিভিত্তির এক চৌকস খেলা। অনুরূপভাবে, হাত গুত্তি খেলাও বুদ্ধি ও দক্ষতার খেলাগুলোর অন্যতম।

আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান বর্ধিঞ্চু, সামাজিক অসংখ্য যোগাযোগের মাধ্যম; হাতের মুঠোয় আজ ক্রিড়া-কলাপ, মুভি, কম্পিউটার বা মোবাইল গেইমস্-এ সমৃদ্ধ প্রযুক্তি নির্ভর বিনোদনবাহার। নিজের মেধার সাথে নিজের প্রতিযোগিতা যেমন ক্রিড়াক্ষেত্রে অযৌক্তিক, তেমনি দ’টি পক্ষ, দু’ পক্ষের একাধিক খেলোয়ার, প্রতিপক্ষের মোকাবেলা, দৌড়ঝাপের মাধ্যমে শারিরীক উন্নতি সময়ানুবর্তিতা, অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া, পরাজয় মেনে নেয়ার ধৈর্য বা বিজয় ছিনিয়ে আনার কৌশল, বিজয়ীর বিনয় বা পরাজিত দলের ভেঙ্গে না যাওয়া আত্মবিশ্বাস-এ সবের জন্য মাঠ-ঘাট খোলা-বিল-ঝিলের প্রতিযোগিতা বা ‘ইনডোর’ বুদ্ধিদীপ্তের খেলার কোন বিকল্প নেই; সামাজিক শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বা সম্প্রীতির প্রতীক সে খেলাগুলোকে যদি আমরা ফিরিয়ে আনতে পারি, যদি খোলা মাঠ দিতে পারি আমাদের ভবিষ্যত নেতৃত্ব তথা আজকের যুবক-কিশোরদের, তবেই প্রকৃত আলোকিত ও সুশৃঙ্খল, মূল্যবোধময় সমাজ বিনির্মিত হবে  আমাদের বিশ্বাস।

মূখ্য তথ্যসূত্র:
ক) আবদুল হক রচনাবলী (১ম ও ২য় খন্ড)
খ) চট্টগ্রামী বাঙলার রহস্যভেদ ড: এনামুল হক।
গ) গ্রাম বাংলার বয়োবৃদ্ধ অধিবাসীদের বর্ণনা।

—–
মোঃ নাজিম উদ্দিন

লেখাটি লিখেছেন