কেমন আছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম?

Jun 24, 2021 | আত্মউন্নয়ন ও মোটিভেশন, রমনী, সুখী সংসার ও গুড প্যারেন্টিং | 0 comments

কেমন আছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম?

নাজমুন রুমি
——

কলেজ হতে ফিরতে ফিরতেই অনুভব করলাম প্রচন্ড মাথা ব্যথাকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরছি । বিকেলে একটা মিটিং আছে, মাথা ব্যথাকে তাই পথেই ফেলে যাওয়ার জন্য, ঔষুধের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম ঔষুধ কিনবো ভেবে, একটা ছোট মেয়ে আমার আগেই দোকানে পা রাখলো দেখে তাকেই আগে সুযোগ দিলাম, দেখলাম আমার এলাকারই স্কুল ড্রেস পরিহিতা, কিন্তু ঐ স্কুল তো বিকেল চারটায় ছুটি হওয়ার কথা, ভাবলাম হয়তো আগে ভাগেই ছুটি হয়েছে,এলোমেলো ভাবনার দেয়ালে এসে আছড়ে পড়লো। মেয়েটার মিষ্টি কণ্ঠ যখন বললো,“আঙ্কেল আমাকে প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট দেন, অমুক ব্র্যান্ডের টা দিবেন”। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মেয়েটির বয়স বড়জোর ১৪-১৫ । আমি নীরবে মেয়েটার চলে যাওয়া দেখলাম,আর আমি মাথাব্যাথার বদলে বাড়ি ফিরলাম অদ্ভুত ‘অবশ’ অনুভূতি নিয়ে ।

ভাবছি, এইযে ১৪ বা ১৫ বছরের মেয়েটা, ওতো এখনো শিশু, এই বয়সে ওর তো রং পেন্সিল কিনার কথা, ঘুড়ি কিনার কথা ,প্রজাপতির পিছু ছুটার কথা,পাখির সাথে ফুলের সাথে কথা বলার কথা,ওর হাতে তো ওই কিট তো মানানসই নয়।

কিছুতেই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলাম না। যেই ভাবনা সেই দিন কয়েক উঠে পড়ে লাগলাম, ওই বয়সী মেয়েদের কাছ থেকে কিছু তথ্য নিলাম অবার ঔষুধের বেশ কিছু দোকানদারের সাথে ও কথা বললাম, যা জানতে পারলাম, এ বয়সী মেয়েরা ও ছেলেরা এসব কীট,  আই পিল,কনডম এসব অহরহ কিনছে। বেশ ধাক্কা খেলাম নিজেরই মনের ভেতর, কারণ আমিও একজন কিশোরীর অভিভাবক। অংক কষছি বয়সের। ১৮ বছর অনুর্ধ যে কেউ শিশু, এরাই জাতির কর্ণধার । বর্তমান বিশ্বে শতকরা ২৬ ভাগ মানুষ ১৫ বছরের নিচে। (ইউনিসেফের হিসেব মোতাবেক) বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ শিশু। এইসব কিশোর কিশোরীরা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাই তাদের সুষ্ঠু ভাবে বেড়ে উঠার উপরেই আমাদের সামগ্রিক সুফল নির্ভর করে।

শৈশব পেরিয়ে তারুণ্যে পা রাখার আগে প্রতিটি ছেলেমেয়ের দেহে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়,যা তাকে পরবর্তীতে প্রজননক্ষম নারী বা পুরুষে পরিণত করে। ছেলেদের ক্ষেত্রে ১২-১৪ বছর বয়সে ,আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ৯-১১ বছর বয়স থেকে শারীরিক পরিবর্তন আসে। এই সময় শরীরের সাথে সাথে মনের ও ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। এই বিষয় নিয়ে বর্তমানে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেও সঠিক উপায়ে, সঠিক কর্মপরিকল্পনার অভাবে এসব সচেতনতা কোন কাজে আসছেনা।

আমাদের দেশে অভিভাবকরা যথাযথ সচেতনতার অভাবে, সন্তানদের বয়ঃসন্ধিকালে একা ছেড়ে দেন এবং অভিভাবকদের সাথে সন্তানের এই সময় দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে । বাবা মায়ের হাত ধরে বেড়ে উঠা শিশুটি হঠাৎ বিশাল পৃথিবীতে একা হয়ে যায় । তখন তারা নিজস্ব এক জগৎ গড়ে নেয়। বয়ঃসন্ধির প্রভাবে শরীর-মনের পরিবর্তিত চাহিদা ও পারিপার্শ্বিক প্রভাব তাকে বিভ্রান্ত করে,যৌনতা সম্পর্কে করে তোলে চরম কৌতূহলী। এ সময় তারা সাধারণত লাজুক, পরনির্ভর ও অন্তর্মুখী হয়ে পড়ে।

তারা না পারে শিশুদের সঙ্গে খেলতে , না পারে বড়দের সঙ্গে সময় কাটাতে। এমনকি তাদের এ শারীরিক পরিবর্তনের কথা বা এ সম্পর্কিত তাদের উৎসুক্য বাবা-মা বা অন্য কারও কাছে প্রকাশ করতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘আকস্মিক শারীরিক এ পরিবর্তন এবং এ বিষয়ে তাদের জ্ঞান না থাকায় কিশোর-কিশোরীরা স্বভাবতই দিশেহারা হয়ে পড়ে। ’

কৈশোরকালীন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় দেশের বেশিরভাগ কিশোর-কিশোরী প্রাথমিক পর্যায়ে সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এর প্রভাবে অনেকের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা বিষয়টি পরিবার বা বড়দের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। অভিজ্ঞ এবং বয়সে বড় কারও কাছ থেকে পরামর্শ না পেলে কিশোর-কিশোরীরা এ সময় বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ গ্লোবাল ফান্ড রাউন্ড ২-এর এইচআইভি/এইডস কর্মসূচির প্রাপ্ত সীমা জরিপে (২০০৯) দেখা গেছে, শতকরা ৩৫ ভাগ নারী এবং ১০ ভাগ পুরুষ ১৫ বছর বয়সের আগেই যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ৪০ ভাগ নারী যৌন কর্মীর গড় বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এছাড়া ২০০৮-এ ইউনিসেফ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোর-কিশোরীদের ৬৩ দশমিক ৯ ভাগই বাণিজ্যিক যৌন কর্মীদের সংস্পর্শে আসে,এই বয়সে শারিরীক পরিবর্তন নিয়ে সৃষ্ট উৎসাহ ও অজ্ঞতার জন্যই। এ প্রসঙ্গে মীনাক্ষী গিগি ডারহামের ২০০৮ সালের লেখা একটি বই- ‘দ্যা ললিতা এফেক্ট’ বইটিতে বলা হয়েছে,“সন্তানরা তুলনামূলকভাবে একেবারে অল্পবয়স থেকেই যৌনতা সম্বন্ধে বিভিন্ন জায়গা থেকে জানতে পারছে। আর সন্তানদের ঘিরে প্রচার মাধ্যমগুলো যে বিষয় গুলো তৈরি করছে ,সেগুলোর মধ্যে যৌনতার বিষয়টা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ।” আবার অনেক অভিভাবকদের ভুল প্যারেন্টিং এর কারণেও তারা সন্তানদের অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে দেন বয়ঃসন্ধিকালে,যার প্রভাবে তারা বিচ্যুত হয় সমাজের প্রচলিত আদর্শ থেকে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এই অনৈতিক মানসিকতা ও অবাধ যৌন সম্পর্ক চর্চার নিয়ে অর্থাৎ এই নতুন বাস্তবতা নিয়ে আমাদের ভাবার সময় এসে গেছে বহু আগেই।

অপরদিকে বিশ্বয়ানের অন্যতম স্বরূপ পুজিঁবাদের ব্যাপক প্রসারে পণ্যের বাজার সর্বোচ্চকরণে বিজ্ঞাপনদাতারা শিশু-কিশোরদের সামনে যৌন উদ্দীপনামূলক বেশভূষার দিকে মনোযোগী করে তোলে এমন বিজ্ঞাপন তৈরি করছে। ডেবরা রফম্যান তার ‘টক টু মি ফার্স্ট’ বইয়ে উল্লেখ করেন, “কথাবার্তা,বিজ্ঞাপন,সিনেমা বই, গানের কথা, টিভির অনুষ্ঠান,সিনেমা,মেসেজ,গেম, বিলবোর্ড,ফোন ও কম্পিউটারের মধ্যে এত বেশি পরিমাণ যৌন সংক্রান্ত ছবি ভাষা এবং ইঙ্গিতমূলক তথ্য আছে যে,তারা (কিশোর কিশোরী ও তাদের চেয়ে ছোট বয়সীরা) ধরে নেয়,(হতে পারে নিজেদের অজান্তেই) যে, যৌনতা হলো জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ” তারা বিভিন্ন ভাবে এই যৌন সম্পর্ক স্থাপনে মরিয়া হয়ে উঠে। তাইতো পত্র পত্রিকায় হরহামেশাই দেখতে পাওয়া যায়, কিশোরদের ধর্ষণ কর্মকান্ডে লিপ্ত হতে, এবং অনেক সময় তারা এরই সাথে মাদক ও খুন খারাবীর মতো ঘটনায় ও জড়িয়ে পড়ে।

অনেক কিশোর কিশোরী পরিবারের আড়লে দুজনের সম্মতিতে ও যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী জানে না তাদের শারীরিক পরিবর্তন, প্রজনন স্বাস্থ্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে পুরোপুরিভাবে। তারা জানে না,অপরিকল্পিত গর্ভধারণ থেকে কীভাবে নিজেদের সুরক্ষা করতে হবে। এইডসসহ প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশল সম্পর্কে তাদের তথ্যের অভাব রয়েছে। অযাচিত এবং অনিরাপদ যৌন সংশ্রব থেকে কীভাবে সুরক্ষা পেতে হবে সেসব জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে জ্ঞান ও তথ্যের ঘাটতির কারণে তারা অনিরাপদ যৌন মিলন, অনিরাপদ গর্ভপাত ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের মুখোমুখি হয়- যা থেকে তারা আক্রান্ত হয় এইডসসহ নানা যৌন রোগে।

পাশ্চাত্যেদেশগুলোতে প্রাথমিক স্কুল পর্যায়েই যৌন শিক্ষা, অর্থাৎ যৌনতা সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে জানানো হয়। যৌন সম্পর্ক কী? কম বয়সে যৌনতার ক্ষতিকর দিকগুলো ও বিশেষ ভাবে তুলে ধরা হয়। তাছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, গর্ভধারন, গর্ভপাত এবং অবশ্যই যৌনরোগ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করা হয় স্কুলেই। নিজের শরীর সম্পর্কেও সচেতন করে দেয়া হয় তাদের। ফলে কোনটা ভালোবাসার স্পর্শ আর কোনটি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সেটা তারা সহজেই বুঝতে পারে বেশ ছোটবেলা থেকেই। যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের মতো কোন পরিস্থিতে করণীয় কী সেটাও তাদের বোঝানো হয়।আমাদের দেশে এমন শিক্ষাদেওয়ার কথা সীমিত আকারে চালু হলেও প্রায়োগিক ক্ষেত্র একে বারেই শূণ্যের কোটায়।

বাংলাদেশ দক্ষিণ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ। এখানের পারিবারিক বন্ধন বিশ্বের অন্যান্য দেশ হতে ভিন্ন ও অনেক দেশের কাছে ঈর্ষন্বীয় হওয়ার মতোই। কিন্তু এ বন্ধন ধরে রাখতে; আকাশসংস্কৃতি আমাদের সন্তানদের মধ্যে অবাধ যৌনতার যে জোয়ার প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে তা আমাদের রূখতে হবে এখনি । বয়ঃসন্ধিতে বাবা মাকেই সন্তানের পরম বন্ধু হয়ে পাশে থেকে, তাদের ধর্মীয় নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। সততা, বিশ্বস্ততা, সম্মান ইত্যাদি শব্দের উপযোগীতা ও এদের প্রভাব সম্পর্কে সন্তান কে শিক্ষা দিতে হবে । যুগে যুগে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারী অভিশপ্ত জাতিদের জীবনকাহিনী ও ধর্মানুসারে তার ফল সম্পর্কে সন্তানদেরকে জানাতে হবে । তাদের জানাতে হবে সব কিছুরই সঠিক সময় এবং সঠিক বয়স আছে। বিয়ন্ড দ্যা টক (আইল্যান্ড সেক্সুয়াল হেলথ এর এডুকেশন প্রোগ্রামিং ) এ বলা হয়, “যে কিশোর কিশোরীরা জানে যে, কিশোর বয়সে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার ব্যাপারে বাবা মায়ের আপত্তি করে,তারা সাধারণত এই কাজে লিপ্ত হয়না।”
আমাদের দেশের বাবা মায়েরাও সুস্পষ্টভাবে সন্তানকে এই বিষয়ে তাদের প্রত্যাশা ও তাদের পারিবারিক মূল্যেবোধের কথা জানিয়ে রাখতে পারেন । জানিয়ে রাখতে পারেন জীবনে ব্যক্তিগত সততা,স্বচ্ছতা ও বিবাহিত জীবনের গুরুত্ব। অভিভাবকদের ও  তাদের নিজেদের জীবন কে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। অনুসরনীয়  আদর্শ হিসেবে নিজের সন্তানের কাছে সামনে নিজেকে দাঁড়াতে হবে। তাছাড়া প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুদের নৈতিক মূল্যেবোধ শিক্ষার সুযোগ অনেক কম ,মূল্যেবোধ বান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যেখানে শিশু কিশোররা অপসংস্কৃতি ও নিজ সংস্কৃতির পার্থক্য সহজেই বুজতে পারবে। পড়া শোনার পাশাপাশি মনোঃজগতের সমৃদ্ধির জন্য তাদের দেশীয় সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সীমিত ও সঠিক ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে , এগিয়ে যাওয়া দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হিসেবে আমাদের কিশোর কিশোরীরা প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে কতটুকু সচেতন তা দেখতে আরো বেশি নজরদারিতার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি। আমরা আমাদের দেশের ঐতিহ্য ও মূল্যেবোধ কে সাথে নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়নের পথে।আমাদের আদর্শ ও মূল্যেবোধের ধারক ও বাহক হয়েই বেড়ে উঠুক আমাদের কিশোর কিশোরী রা।

(করোনাক্রান্তির কিছু সময় আগের দিনলিপি থেকে)

লেখক : নাজমুন রুমি।

প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কলেজ

লেখাটি লিখেছেন